শেখ হাসিনা
,

আওয়ামী লীগের তিন মাস পরেও ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’: ক্ষমতাচ্যুতির পরও আত্মসমালোচনার অনুপস্থিতি

ক্ষমতা হারানোর তিন মাস পরও, ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ তাদের কৃতকর্মের জন্য কোনো স্পষ্ট অনুশোচনা বা আত্মসমালোচনার পথে না গিয়ে পুরো ঘটনার পেছনে ষড়যন্ত্রকেই দায়ী করছে। দলের শীর্ষ নেতারা মনে করেন যে এটি ছিল পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র এবং শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে বিএনপি-জামায়াতসহ বিদেশি শক্তির পরিকল্পনার অংশ ছিল।

আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা বিশেষ করে ছাত্র আন্দোলনের ওপর বলপ্রয়োগকে একটি কৌশলী পদক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে এবং এর মধ্য দিয়ে, দলটির ঐক্য পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগ স্থাপন করা হচ্ছে।

‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’: আওয়ামী লীগের ভিন্নমত

গত আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ ক্রমাগত এই ঘটনাকে একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মধ্যে ফেলে অভিহিত করে আসছে। শীর্ষ নেতারা মনে করেন যে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা এবং দেশের কিছু বিদ্রোহী দল এর পেছনে মদত জুগিয়েছিল। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনা এবং দলের অন্যান্য নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা দায়ের করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

“এই ষড়যন্ত্রের কারণেই শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে,” বলছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম।

অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে দলটির কর্মীদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ একপ্রকার দিশাহারা হয়ে পড়ে।

আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা

জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত সহিংসতার পর দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ও একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে এবং তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরাও তাদের এলাকায় ফিরে আসছেন বলে জানা যায়। যদিও অনেকেই মনে করেন যে, শীর্ষ নেতাদের বিদেশ থেকে কর্মসূচি ঘোষণার ফলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা আরও বিপদের মুখে পড়ছে।

আওয়ামী লীগের কর্মীরা কেবল সংগঠনের অভ্যন্তরেই নয়, বরং সাধারণ মানুষের মনেও প্রচণ্ড অসন্তোষ ও হতাশা বিরাজ করছে।

শেখ হাসিনার বক্তব্য: ‘একটি ষড়যন্ত্রের অংশ’

শেখ হাসিনা নিজেই প্রথম থেকেই এই আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। ২৪ জুলাই, গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে, “এটা যে একটা বিরাট চক্রান্ত, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল।” তিন মাস পরও আওয়ামী লীগ এ ধরনের বক্তব্যই উপস্থাপন করে আসছে।

“সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও এ ধরনের ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করেছেন,” বলেন বাহাউদ্দিন নাছিম। গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস এমনকি উল্লেখ করেন যে, আন্দোলন খুবই পরিকল্পিতভাবে চালানো হয়েছে।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস রাখলেও আওয়ামী লীগ তাদের কৃতকর্মের কারণে যে জনসমর্থন হারাচ্ছে, সেটি পুনরুদ্ধারে সক্ষম না হলে রাজনৈতিক মঞ্চে তাদের পা রাখা কঠিন হবে।

আন্দোলন দমনে বলপ্রয়োগ এবং হতাহতের ঘটনা

জুলাই-অগাস্টের ছাত্র আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনার সরকার সহিংসতার মাধ্যমে যেভাবে বলপ্রয়োগ করেছে, তা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। অন্তর্বর্তী সরকারের তালিকা অনুযায়ী, সেই সহিংসতায় প্রায় ৮০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন বিশ হাজারেরও বেশি মানুষ, যাদের মধ্যে অনেকেই দেহের অঙ্গ হারিয়েছেন এবং জীবনব্যাপী পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই সহিংসতার দায় সম্পূর্ণরূপে না নিয়ে এর জন্য তৃতীয় পক্ষের ষড়যন্ত্রকেই দায়ী করা হচ্ছে।

“আমরা বলে আসছিলাম যে, এই আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ রয়েছে, যাদের কারণে সাধারণ মানুষ হতাহত হয়েছেন,” বলেন বাহাউদ্দিন নাছিম।

কৃতকর্মের জন্য আত্মসমালোচনা

একদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা ক্ষমতার সময়ে কিছু ভুল ও ত্রুটি স্বীকার করলেও তাদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে শুদ্ধি আনার প্রয়াস এখনও দেখা যায়নি। দীর্ঘ দেড় দশক ক্ষমতায় থাকার পরও, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, গত ১৫ বছরে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এবং ‘ক্রসফায়ার’ এর নামে দুই হাজারের বেশি মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। এছাড়াও গুমের ঘটনাগুলোর একটি বড় অংশের কোনো হদিস না পাওয়ায় এ বিষয়ে আওয়াজ উঠেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচিত হয়েছে।

“আমরা আত্মসমালোচনা করছি এবং নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছি,” বলেন বাহাউদ্দিন নাছিম। কিন্তু কিছু তৃণমূল নেতা মনে করছেন যে, এসবের সঠিক দায় নিতে না পারলে মাঠের রাজনীতিতে তাদের ফেরা কঠিন হবে।

সংগঠন পুনর্গঠনে মনোবল চাঙ্গা করার চেষ্টা

অক্টোবর মাস থেকে আওয়ামী লীগকে তাদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে। দলের ভেরিফায়েড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পেজগুলিতেও বেশ সক্রিয় ভূমিকায় অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে। তবে সরকারবিরোধী বড় কোনো কর্মসূচিতে যাওয়ার আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানান বাহাউদ্দিন নাছিম।

“আত্মগোপন থাকা অবস্থায় আমাদের কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে,” বলেন তিনি। “পরিস্থিতি বিবেচনায় জনসাধারণের জন্য যে ধরনের কর্মসূচি প্রয়োজন, সেটিই নেওয়া হবে।”

শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কিছু অদৃশ্য সংহতির প্রয়াস লক্ষ্য করা গেলেও, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

আরও পড়তে পারেন