বাংলাদেশে চলমান মূল্যস্ফীতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান দামের চাপে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে। আয় স্থির থাকলেও ব্যয়ের দৌড় থামছে না। এই আর্থিক চাপ থেকে বাঁচতে বাজারের ফর্দ ছোট করে ফেলছেন অনেকে, কমিয়ে দিচ্ছেন পুষ্টিকর খাবারের চাহিদা।
অন্তর্বর্তী সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারও জানিয়েছেন, ‘‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য ক্রেতা হিসেবে আমিও চাপে আছি।’’ তার এমন মন্তব্য বাজারের ভয়াবহ পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট করে।
অন্যদিকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের হতাশা, ‘‘৫০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে দু’মুঠো শাক কিনতেই টাকা শেষ।’’
বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি
প্রতিদিনের বাজারে ক্রেতাদের নাভিশ্বাস। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, আলু, চিনি— কোনো কিছুই আর আগের দামে নেই। চালের কেজি ৫২ থেকে ৬৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। ডালের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ, তেলের দাম ১১ শতাংশ, আর আলুর দাম প্রায় ২২ শতাংশ।
একজন ক্রেতা বলছিলেন, ‘‘শীতের সবজি সস্তা হলেও বাকি জিনিসগুলোর দাম এমন যে, শাক-সবজি দিয়ে দিন চালাতে হয়। মাছ-মাংস কেনা যেন স্বপ্ন হয়ে গেছে।’’
ফলমূলের দামও এখন নাগালের বাইরে। কারওয়ান বাজারের এক ব্যবসায়ী জানান, ‘‘মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বিক্রিও কমে গেছে। ফলের চেয়ে ভাত-ডাল কিনতেই এখন মানুষ বেশি মনোযোগী।’’
আয়ের তুলনায় ব্যয়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি
গড় আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না বলে অনেক পরিবারে খরচের সঙ্গে আয়ের ভারসাম্য মেলানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে গড় শ্রম মজুরি বেড়েছে মাত্র ৮ শতাংশ, যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
অর্থাৎ আয়ের তুলনায় ব্যয় প্রায় ২ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। খাদ্যখাতে এ ব্যয় আরও বেশি, ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
রাজধানীর বাসিন্দা আবদুর রহমান জানান, ‘‘আমার বেতন ৪৮ হাজার টাকা, অথচ মাসের শেষে হাতে থাকে মাত্র ১১ হাজার। এ টাকায় পরিবার চালানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। কোনো বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হলে ধারদেনা না করে উপায় নেই।’’
টিসিবির ট্রাকের ওপর নির্ভরশীলতা
বাজারের এই কঠিন অবস্থায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য টিসিবির ট্রাক একটি ভরসার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার দুই সিটিতে প্রতিদিন ৫০টি ট্রাকে পণ্য বিক্রি করা হলেও মানুষের চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।
বেশিরভাগ মানুষই পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যান। তেজগাঁওয়ের বাসিন্দা রাহেলা বেগম বললেন, ‘‘বাজারে জিনিসের দাম বেশি। টিসিবির ট্রাকের পণ্যই ভরসা। তবে তা পাওয়াও খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’
এদিকে এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অনিক হোসেন বলেন, ‘‘টিউশনির আয়ে মেসের খরচ চালাই। ভালো খাবার খাওয়া তো দূরে থাক, কোনো মতে দিন পার করতে হচ্ছে।’’
সরকারের উদ্যোগ ও ব্যর্থতা
দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে সরকার নানান পদক্ষেপ নিয়েছে। বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে শুল্ক কমানোর মাধ্যমে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে।
চালে শুল্ক ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। আলু, পেঁয়াজ, ডিমের শুল্ক উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানো হয়েছে। তেল ও চিনিতে ভ্যাট হ্রাস করা হয়েছে।
তবু বাজারের দাম কমেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘‘শুল্ক কমানো হলেও ভোক্তারা এর সুফল পাচ্ছেন না। সিন্ডিকেট এবং মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজারকে অস্থির করে রেখেছে।’’
অর্থনীতিবিদ ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘‘সরবরাহ ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে হবে। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমিয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরি করতে হবে।’’
ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি
২০২৩ সালের মার্চ মাস থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। অক্টোবর মাসে তা বেড়ে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
খাদ্যখাতে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর প্রভাবে নিত্যদিনের বাজার থেকে পুষ্টিকর খাবার হারিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘‘উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি টাকার প্রবাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।’’
সিন্ডিকেট ভাঙার প্রয়োজনীয়তা
দাম বৃদ্ধির বড় কারণ হিসেবে সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন প্রণয়ন এবং ২০১৬ সালে প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করলেও সিন্ডিকেট ভাঙা যায়নি।
এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘‘সিন্ডিকেট দমনে আইনের কার্যকর প্রয়োগ প্রয়োজন। যেসব ব্যবসায়ী বাজার অস্থির করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’’
খাদ্য নিরাপত্তার সংকট
খাবারের তালিকা ছোট হওয়ায় বহু পরিবার পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘‘এভাবে চলতে থাকলে দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্যে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।’’
সরকারকে খাদ্য নিরাপত্তার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি ভর্তুকি বাড়িয়ে নিম্ন আয়ের মানুষকে সুরক্ষা দিতে হবে।
সাধারণ মানুষের আকুতি
এই সংকটে ভুক্তভোগী মানুষ দিশাহারা। এক ক্রেতা বলছিলেন, ‘‘জীবন চালানোই কঠিন হয়ে গেছে। সব পণ্যের দাম বাড়ছে, অথচ আয় বাড়ছে না।’’
সরকারের কাছ থেকে তারা চায় কার্যকর সমাধান। বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
বাজার পরিস্থিতি যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।