সরকার পতনের পর সংকট কাটিয়ে দ্রুততার জন্য চলছে ব্যাপক রদবদল, লক্ষ্য জনআস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা
হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের পুলিশ বাহিনীতে একের পর এক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
গত তিন মাসে প্রায় ২৫ শতাংশ পুলিশ সদস্যের কর্মস্থল বদল করা হয়েছে, যা এক নজিরবিহীন ঘটনা।
এমন দ্রুত পরিবর্তনের লক্ষ্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি জনআস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
পুলিশ বাহিনী বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও স্বচ্ছ কার্যক্রমের জন্য কাজ করছে।
নতুন নেতৃত্বের অধীনে প্রতিদিনই পুলিশের বিভিন্ন পদে আসছে নতুন মুখ, যা পুলিশের গতিশীলতার চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গত তিন মাসে সারাদেশের দুই লাখ দুই হাজার পুলিশ সদস্যের মধ্যে প্রায় ৪৫ হাজারের পদায়ন পরিবর্তন করা হয়েছে।
এই রদবদলের প্রক্রিয়ায় দেশের ৬৪ জেলার পুলিশ, সব রেঞ্জের ডিআইজি, মহানগর কমিশনার, এবং সব থানার ওসি পদে এসেছে নতুন কর্মকর্তা।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকার পতনের পর পুলিশে এমন বড় ধরনের রদবদল এর আগে কখনো দেখা যায়নি।
দেশের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
এখানে মোট ৩২ হাজার সদস্য কর্মরত আছেন, যার মধ্যে ১৮ হাজার সদস্যের স্থানান্তর ঘটেছে।
নতুন পরিবেশে কাজের ধরন সম্পর্কে ধারণা দিতে এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ফারুক আহমেদ জানিয়েছেন, কর্মস্থল রদবদলের বিকল্প ছিল না।
কোনো থানার জন্য জনসম্পৃক্ত পুলিশ সদস্যের গুরুত্ব অপরিসীম, তাই স্থানীয় জনগণের আস্থা ফিরে পেতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সদস্যদের ঢাকায় স্থানীয় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।
একই সঙ্গে, বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর রদবদলের ফলে কোনো নেতিবাচক প্রভাব যাতে না পড়ে, সেই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল
হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন পরিস্থিতির আলোকে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে রদবদল শুরু হয়েছে।
এর মধ্য দিয়ে পুরোনো বলয় ভাঙা এবং দক্ষ, যোগ্য সদস্যদের সামনে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
গত সাড়ে ১৫ বছরে ডিএমপির কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে একই মুখ দেখার ফলে অনেক দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তা পদোন্নতির সুযোগ পাননি।
এখন তাদের সামনে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা পুলিশের কার্যক্ষমতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ডিএমপির ক্রাইম বিভাগের ওসি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে নতুন মুখ আসায় পুলিশের কাজে উদ্যম ফিরে আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রদবদলের প্রক্রিয়া ও নতুন চ্যালেঞ্জ
সরকারের প্রভাবমুক্ত থেকে পুলিশের কাজ পরিচালনার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেছেন, দেশের পরিবর্তনের সাথে সাথে পুলিশেও বড় ধরনের রদবদল জরুরি হয়ে পড়েছিল।
এই রদবদলের ফলে পুলিশের পেশাদারিত্ব ও স্বচ্ছতার মাত্রা বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।
তবে, নতুনভাবে যারা দায়িত্বে আসছেন, তাদেরকে নতুন এলাকার অপরাধীদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জানতে কিছুটা সময় লাগবে, যা সাময়িকভাবে অপরাধীদের জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারে।
বিভিন্ন বিশেষায়িত ইউনিটের সদস্যদের বদলির মাধ্যমে পুরো বাহিনীর দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির চেষ্টা করা হচ্ছে।
এআইজি ইনামুল হক সাগর জানিয়েছেন, পুলিশকে গতিশীল করার জন্যই এই রদবদল প্রয়োজন ছিল।
পদোন্নতি ও পদায়নে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
গণঅভ্যুত্থানের পর দাবি উঠেছে পুলিশ সংস্কারের
সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।
পুলিশ সদস্যরা দাবি করছেন, পুলিশ বাহিনীকে রাজনীতিমুক্ত করা এবং একটি সংহত নীতিমালার ভিত্তিতে বদলি ও পদায়ন হওয়া উচিত।
গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশের কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে।
এটি কাটিয়ে উঠতে পুলিশের অভ্যন্তরে সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে এবং বেশ কিছু কমিটিও কাজ করছে।
নিরপেক্ষ ও দক্ষ কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসার সুযোগ পাচ্ছেন, যা বাহিনীর মনোবল বৃদ্ধির মাধ্যমে পুলিশের কার্যক্ষমতা উন্নত করবে।
ঢেলে সাজানো হচ্ছে পুলিশ বাহিনী
ঢাকা মহানগর পুলিশের ৫০ থানাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল ঘটেছে, যার ফলে জনসংযোগ এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির প্রত্যাশা রয়েছে।
বিভিন্ন থানায় ওসি পদে নবীন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ফারুক আহমেদ বলেছেন, দায়িত্বের প্রতি আন্তরিক থেকে নতুন সদস্যদের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
এর পাশাপাশি, বয়স্ক সদস্যদের ওসি পদে পদায়ন দেওয়া হলেও তাদের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার গুরুত্ব বিবেচনা করে তা করা হয়েছে।
ঢাকার বিভিন্ন থানায় স্থানীয় অপরাধীদের নেটওয়ার্কের সাথে মেলামেশা করে নতুন সদস্যদের দ্রুত কাজে দক্ষ করে তোলা হচ্ছে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির পথে
সরকার পরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো সন্তোষজনক অবস্থায় পৌঁছেনি।
ঢাকার বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যকে রদবদল করা হয়েছে, যাদের জন্য নতুন এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সময় লাগছে।
তবে, সরকার ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করছেন যে, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আরও উন্নত হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য সময় দরকার, তবে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে পরিস্থিতি শীঘ্রই নিয়ন্ত্রণে আসবে।
দীর্ঘদিনের পদ্ধতি পরিবর্তনে সন্তুষ্টি
খুলনায় পুলিশের বদলি প্রক্রিয়ায় লটারির মাধ্যমে পদায়ন দেওয়া হয়েছে, যা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই উদ্যোগের ফলে দীর্ঘদিনের পদায়ন বাণিজ্য ও স্বজনপ্রীতি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা করা হচ্ছে।
এছাড়াও, পুলিশ সদরদপ্তর থেকে প্রতারণার অভিযোগে সতর্ক থাকার জন্য একটি বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বর্তমান পরিবর্তনের ধারায় পুলিশ বাহিনীর মধ্যে নিরপেক্ষতা, দক্ষতা ও জনসংযোগ বৃদ্ধি পাওয়ার আশা করা হচ্ছে, যা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে।
এই পরিবর্তনসমূহ পুলিশের নতুন রূপে গতি ফেরানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।