আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, দেশে ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত কথিত গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্প্রতি দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আরও কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।
আদালত আগামী ১৮ই নভেম্বরের মধ্যে শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য পলাতক আসামিদের আদালতে হাজির করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন।
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্পষ্ট করেছে যে তারা ইন্টারপোলের মাধ্যমে এই সব পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নেবে।
সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল রবিবার বলেন, “পলাতক ফ্যাসিস্ট চক্র পৃথিবীর যে দেশেই থাকুক, ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।”
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা বাস্তবায়নের চেষ্টা, এর কার্যকারিতা, এবং আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জগুলো বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।
ইন্টারপোলের রেড নোটিশের গুরুত্ব এবং কার্যপ্রক্রিয়া
ইন্টারপোলের রেড নোটিশ একটি আন্তর্জাতিক সতর্কীকরণ ব্যবস্থা, যা কোনো দেশের অনুরোধে জারি করা হয় এবং এতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে অবহিত করা হয় যে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি আইনি তদন্ত বা গ্রেফতারি পরোয়ানার আওতায় রয়েছে।
ইন্টারপোলের সদস্য দেশগুলো, যার মধ্যে ১৯৪টি দেশ রয়েছে, রেড নোটিশ জারি হলে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে সচেতন হয় এবং তার অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনে তাদের দেশের আইন অনুসারে গ্রেফতার করতে পারে।
বাংলাদেশ পুলিশের আবেদনের ভিত্তিতে শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য পলাতকদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনাসহ পলাতক আসামিদের ফেরত আনতে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করবে।”
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা জানান, “রেড এলার্ট মানে অমুক লোক, এর বিরুদ্ধে আমাদের এখানে মামলা বা ওয়ারেন্ট আছে। ওই আসামি যে দেশে আছে সেই দেশের পুলিশ বিভাগকে ওই আসামির ওপর নজর রাখতে বলবে।”
রেড নোটিশের মাধ্যমে ইন্টারপোল সাধারণত সেই আসামির ছবি, ব্যক্তিগত তথ্য, অপরাধের বিবরণ এবং অন্য প্রাসঙ্গিক তথ্য সন্নিবেশিত করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কাছে একটি আন্তর্জাতিক বার্তা পাঠায়।
তবে, ইন্টারপোল শুধু গ্রেফতারি নোটিশ দিয়েই শেষ করে না; তারা সংশ্লিষ্ট দেশের আইনি এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার সঙ্গে সহযোগিতাও করে।
ইন্টারপোল রেড নোটিশ এবং রাজনৈতিক পলাতক ব্যক্তিদের ফেরত আনার চ্যালেঞ্জ
ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৬৪ জন বাংলাদেশি পলাতক আসামির বিরুদ্ধে রেড নোটিশ কার্যকর রয়েছে।
তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ফৌজদারি অপরাধ এবং বিভিন্ন হত্যা মামলার আসামি, যাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
তবে রাজনৈতিক পলাতকদের ক্ষেত্রে রেড নোটিশ কার্যকর করা কিছুটা জটিল এবং সংবেদনশীল, কারণ এতে দেশগুলোর রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয় জড়িত থাকে।
২০১৫ সালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছিল।
২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ বিভিন্ন মামলার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে ওই বছরের দোসরা জুলাই রেড নোটিশ জারি করা হয়।
তবে, তারেক রহমানের আইনজীবীরা এই রেড নোটিশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন, এবং পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ১৪ই মার্চ ইন্টারপোলের তালিকা থেকে তার নাম প্রত্যাহারের নির্দেশ প্রদান করা হয়।
বর্তমানে ইন্টারপোলের তালিকায় যে ৬৪ জন বাংলাদেশির নাম রয়েছে, তার মধ্যে তারেক রহমানের নাম নেই, যা প্রমাণ করে যে শুধু রেড নোটিশ জারি করলেই কাউকে দেশে ফেরত আনা সম্ভব নয়।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা তাকে যে দেশে নেয়া হবে সেই দেশের পরিস্থিতি কেমন, কিংবা রাজনৈতিক কোনো কারণ আছে কি না সেগুলোও বিচার বিশ্লেষণ করা হয়। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক কাউকে ফৌজদারি অপরাধে আটক দেখিয়ে আনা খুব একটা সহজ নয়।”
ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তি এবং এর প্রভাব
ভারত সরকার নিশ্চিত করেছে যে শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে, যার আওতায় প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত বা ফেরার আসামিদের পরস্পরের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব।
এ ধরনের চুক্তির আওতায় আসামিদের প্রত্যর্পণ করা সম্ভব হলেও, কেন বাংলাদেশ সরাসরি এই চুক্তি অনুসরণ না করে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন যে ইন্টারপোলের মাধ্যমে কাউকে দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া চুক্তির চেয়ে কঠিন হতে পারে, কারণ ইন্টারপোলের রেড নোটিশের ক্ষেত্রে প্রায়শই রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতা দেখা দেয়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ইন্টারপোল আসামিদের অবস্থান সম্পর্কে জানার পর সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে, তবে এটি একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় এবং অন্যান্য নজির
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আবুল কালাম আযাদকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছিল।
তবে, বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান এবং তাকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে।
ইন্টারপোলের তালিকায় বর্তমানে ৬৪ জন অভিযুক্ত বাংলাদেশি আসামির মধ্যে আবুল কালাম আযাদের নামও রয়েছে।
তবে বহু বছর পার হলেও তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
এই ধরনের নজিরই ইঙ্গিত দেয় যে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করলেই গ্রেফতার ও প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া সহজ হয় না।
ইন্টারপোল কীভাবে কাজ করে এবং কেন রেড নোটিশ সর্বশক্তি নয়
ইন্টারপোল বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন হলো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যা সারা বিশ্বের পুলিশ বাহিনীকে অপরাধীদের ধরতে সহায়তা করে।
এর প্রধান কাজ অপরাধীদের শনাক্তকরণ, আন্তর্জাতিক তদন্ত সহায়তা এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা।
যদি কোনো দেশে কোনো অপরাধী সেখানে অপরাধ করার পর অন্য দেশে চলে যায়, তখন সেই অপরাধীকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা লাগে।
ইন্টারপোলের মাধ্যমে একবার কোনো ব্যক্তি বা পলাতকের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হলে সেই নোটিশ ১৯৪টি সদস্যভুক্ত দেশের কাছে পাঠানো হয়।
মূলত ইন্টারপোলের এমন একটি ডাটাবেস রয়েছে যেখানে অপরাধীদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সন্নিবেশিত থাকে।
এই ডাটাবেসে অপরাধীদের ছবি বা স্কেচ, ক্রিমিনাল প্রোফাইল, চুরি হওয়া পাসপোর্ট, যানবাহন এবং জালিয়াতির তথ্য পাওয়া যায়।
তবে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বলেন, “রেড নোটিশের মাধ্যমে কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হলে, তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য সেই দেশের জুডিশিয়াল অথরিটির সহায়তা প্রয়োজন।”
এর অর্থ হলো, ইন্টারপোল শুধুমাত্র সহায়ক সংস্থা হিসেবে কাজ করে এবং গ্রেফতার বা প্রত্যর্পণ সরাসরি সেই দেশের বিচারিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশে ইন্টারপোলের সহায়তায় গ্রেফতার এবং প্রত্যর্পণের বর্তমান পরিস্থিতি
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারপোলের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ১৭ জন অভিযুক্ত আসামিকে বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে।
তবে এই সংখ্যাটি যথেষ্ট কম, কারণ বহু অপরাধী বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন এবং তাদের ফিরে আনার প্রক্রিয়া অনেক জটিল।
সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারপোলের সহায়তায় দেশের বাইরে পলাতকদের ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশের সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় পরিস্থিতি এখনও অনিশ্চিত।
ইন্টারপোল রেড নোটিশের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত আনার সম্ভাবনা
শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য অভিযুক্ত পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের এই প্রয়াস একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
যদিও ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবুও রাজনৈতিক কারণে এই প্রক্রিয়া জটিল এবং সময়সাপেক্ষ হতে পারে।
এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হবে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক অবস্থান এবং কূটনৈতিক সম্পর্কগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা করা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়াগুলো সফলভাবে পরিচালনা করা যায় এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলো সহযোগিতা করে, তবে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া সফল হতে পারে।
তবে সময়ই বলবে, ইন্টারপোলের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টা কতটা কার্যকর হয় এবং কীভাবে রাজনৈতিক পলাতকদের নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করা যায়।