দুই দশকের মিত্রতার পর বিএনপি ও জামায়াত পৃথক পথে, জাতীয় নির্বাচনের আগে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে দূরত্ব
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) ও জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে ছিল। ১৯৯০ এর দশকের পর থেকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এই দুটি দল প্রায়শই একসঙ্গে কাজ করে আসছে। বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলে বিএনপি ও জামায়াতের জোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে, দেশটির রাজনীতিতে এই জোটের স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিনের মিত্রতা সত্ত্বেও বিএনপি এবং জামায়াত ক্রমশ পৃথক পথে হাঁটছে। বিশেষ করে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটাতে এই দুটি দলের আলাদা কৌশল অবলম্বন করার প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে।
বিএনপির নেতৃত্বে জামায়াতের সঙ্গে জোট বজায় রাখার একটি প্রচেষ্টা কিছুটা বিদ্যমান ছিল, তবে দলটি এখন কৌশলগতভাবে দূরত্ব বজায় রাখার কথা চিন্তা করছে। তাদের নেতৃবৃন্দ মনে করছেন, জামায়াতের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা তাদের রাজনৈতিক সাফল্যের পথে অন্তরায় হতে পারে। এর ফলে জামায়াতও নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করতে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিকল্পনা করছে এবং দেশজুড়ে ধর্মীয় দলগুলোর মধ্যে আরও মজবুত সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। এতে উভয় দলের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সম্ভাবনা ও কৌশল একেবারেই নতুন দিক নির্দেশনা পাচ্ছে।
বিএনপির জামায়াতের প্রতি নির্ভরতা কমানো: বামপন্থী দলের সাথে ঐক্যের চেষ্টা
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি মনে করছে যে জামায়াতের সঙ্গে অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা তাদের জন্য রাজনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। এই কারণেই তারা নতুন মিত্র খোঁজার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি বিভিন্ন বামপন্থী দল, যেমন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-এর সঙ্গে সংলাপ চালাচ্ছে এবং বিভিন্ন সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করছে। তাদের লক্ষ্য একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক জোট গঠন করা যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ এবং দর্শনের দলগুলো একত্রিত হয়ে কাজ করবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বলেন, “আমরা এমন একটি জোট গঠনের চেষ্টা করছি যেখানে সব দল একসঙ্গে জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা করতে কাজ করতে পারে। আমাদের লক্ষ্য নিরপেক্ষ নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করা, যা জনগণের প্রকৃত মতামতকে প্রতিফলিত করবে।” বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপির এই পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা, কারণ এটি তাদেরকে জামায়াতের ওপর নির্ভরতা কমাতে সহায়ক হতে পারে।
জামায়াতের নতুন রাজনৈতিক লক্ষ্য ও স্বতন্ত্র অবস্থান গঠন
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির সাথে জোট থাকার কারণে জামায়াতের রাজনৈতিক কার্যক্রমে কিছুটা সীমাবদ্ধতা ছিল। তারা প্রায়ই বিএনপির রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে, যা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আদর্শকে সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। তবে বর্তমানে জামায়াত তাদের নিজস্ব রাজনীতির দিক খুঁজতে শুরু করেছে এবং দেশের ইসলামী ধারার অন্যান্য দলগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে মনোযোগী হয়েছে।
জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক ইসলামি দলগুলোকে একত্রিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন। তিনি মনে করেন, এই ধরনের ঐক্য তাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে সুসংহত করবে এবং একটি শক্তিশালী ইসলামী প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলবে। তবে এই পদক্ষেপে বিএনপি-জামায়াতের ঐতিহাসিক মিত্রতা কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। জামায়াতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তাদের এই উদ্যোগ বিএনপির ওপর নির্ভরশীলতা কমাবে এবং নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা কার্যকর করতে সাহায্য করবে।
অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মতবিরোধ
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন এবং প্রশাসনে জামায়াতের প্রভাব নিয়ে বিএনপির মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিএনপির ধারণা, সরকার বর্তমানে জামায়াতকে প্রশাসনিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন সরকারি চাকরি, প্রশাসন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জামায়াত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়োগ এবং প্রভাব বিস্তারের সুযোগ প্রদান করছে। এর ফলে প্রশাসন ও শিক্ষাক্ষেত্রে জামায়াতের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বিএনপির মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে জামায়াতের নেতাকর্মীদের নিয়োগ নিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বিএনপির নেতাদের মতে, এটি জামায়াতকে আরও ক্ষমতাশালী করে তুলবে এবং তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে প্রশাসনিক প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ দেবে। জামায়াতের নেতারা মনে করেন, এটি তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে সুসংহত করবে এবং প্রশাসনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হবে।
তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপি-জামায়াতের দ্বন্দ্ব
কেন্দ্রীয় পর্যায়ের মতই তৃণমূল পর্যায়েও বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘাতের খবর প্রায়শই শোনা যাচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদল এবং শিবিরের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দুই দলের নেতাকর্মীরা একে অপরের বিরোধিতা করছে। তৃণমূল পর্যায়ের এই দ্বন্দ্ব দল দুটির দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ককে প্রভাবিত করছে এবং স্থানীয় পর্যায়ে তাদের জনপ্রিয়তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে কথা বলছে। এ ধরণের আক্রমণাত্মক মনোভাব দল দুটির ভবিষ্যৎ মিত্রতার সম্ভাবনাকে ক্রমশ ক্ষীণ করে তুলছে। বিশ্লেষকদের মতে, কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে এই বিভাজন আরও গভীর হলে বিএনপি ও জামায়াতের একসঙ্গে কাজ করার সম্ভাবনা কমে যাবে।
ভারত সম্পর্কের জটিলতা ও বিএনপি-জামায়াত বিভাজন
বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে আরও একটি বড় মতপার্থক্যের বিষয় হলো ভারত সম্পর্ক। জামায়াত সাম্প্রতিককালে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে সুর তুলেছে। জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, “আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। প্রতিবেশী বদলানো যায় না। ভারত আমাদের পাশের দেশ এবং সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে।” এই ধরনের বক্তব্যে বিএনপির মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। বিএনপি মনে করে, জামায়াত ভারতীয় রাজনীতির প্রভাবের ফাঁদে পড়তে পারে এবং এটি তাদের দেশপ্রেমিক অবস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার বক্তব্যে দলীয় নেতাকর্মীদের ভারতীয় প্রভাব থেকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
এই বিষয়ে তারেক রহমান বলেন, “বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ভারতীয় প্রভাবের শিকার হচ্ছে এবং বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিচ্ছে, যা দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।”
বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ: পৃথক রাজনৈতিক পথ ও সম্ভাব্য প্রভাব
বিএনপি ও জামায়াতের বর্তমান দূরত্ব দেশের রাজনীতিতে নতুন গতিপথ তৈরি করেছে। যদিও অতীতে তারা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে একাধিক সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে, তবে বর্তমানে তাদের মধ্যে আদর্শিক এবং কৌশলগত দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। জামায়াত তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে চায় যেখানে ইসলামী মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় ইস্যুগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে রাজনীতি করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে, বিএনপি একটি বহুমাত্রিক জোট গঠনের দিকে মনোযোগী, যাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের সমন্বয় সাধন করে একটি শক্তিশালী মঞ্চ তৈরি করা যায়।
বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি-জামায়াতের এই পরিবর্তন ভবিষ্যতে উভয় দলের রাজনৈতিক শক্তি ও প্রভাবকে আলাদাভাবে মূল্যায়িত করতে সহায়ক হবে। যদি জামায়াত একটি শক্তিশালী ইসলামী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে সক্ষম হয়, তবে এটি বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। অন্যদিকে, বিএনপির নতুন জোট গঠন প্রচেষ্টা সফল হলে তারা আরও ব্যাপক জনগণের সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হবে এবং তাদের কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী হবে।