,

গর্ভনিরোধক ইনজেকশন নিয়ে বাংলাদেশের নারীরা ঝুঁকিতে

সরকারিভাবে বিতরণকৃত জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশনে ওষুধের ঘাটতি, অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের শঙ্কা

বাংলাদেশে গর্ভনিরোধক ইনজেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহী নারীদের জন্য সাম্প্রতিক এক ঘটনা উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।

এই জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশনটি তিন মাসের মেয়াদে কার্যকর থাকার কথা, কিন্তু মাঠ পর্যায়ে বিতরণ করার সময় এতে ওষুধের পরিমাণ কম পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

ওষুধের এই ঘাটতির কারণে অনেক নারীর অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা এই ঘটনাকে ‘গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি’ বলে অভিহিত করেছেন এবং নারীদের পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন।

এ নিয়ে ইতোমধ্যেই পরিবারের পরিকল্পনা অধিদপ্তর তদন্ত শুরু করেছে এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থা টেকনো ড্রাগস লিমিটেডকে জবাবদিহির জন্য তলব করেছে।

জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশনে ওষুধের পরিমাণ কম থাকার অভিযোগ

সরকারি খরচে দেওয়া জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশনগুলো মূলত দরিদ্র শ্রেণির নারীদের জন্য বিতরণ করা হয়।

সারাদেশে টেকনো ড্রাগস লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি এই ইনজেকশন সরবরাহ করে থাকে।

সম্প্রতি মানিকগঞ্জ, জামালপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, শেরপুর, নওগাঁসহ আরও কয়েকটি জেলায় এই ইনজেকশন প্রয়োগের পর স্বাস্থ্যকর্মীরা লক্ষ করেন যে, ইনজেকশন ভায়ালগুলোর মধ্যে ওষুধের পরিমাণ কম।

মাঠকর্মীরা বিষয়টি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নজরে আনেন, এবং অধিদপ্তর অভিযোগের প্রমাণ পায়।

অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের শঙ্কা

ওষুধের পরিমাণ কম থাকায় এই ইনজেকশন সঠিকভাবে কাজ না করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের ঝুঁকির পাশাপাশি এই পরিস্থিতি নারীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যকে বিপন্ন করতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফারজানা শারমিন শুভ্রা জানান, গর্ভনিরোধক ইনজেকশনগুলোর সঠিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য এতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ওষুধ থাকা আবশ্যক।

তিনি বলেন, “যারা ইতিমধ্যে ইনজেকশনটি গ্রহণ করেছেন, তাদের শরীরের উপর এই ওষুধের ঘাটতি প্রভাব ফেলতে পারে এবং তাদের এখন পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা উচিত।”

টেকনো ড্রাগসের বিরুদ্ধে অভিযোগ

সারাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান টেকনো ড্রাগস লিমিটেডের বিরুদ্ধে এই ধরনের ওষুধের ঘাটতির অভিযোগ নতুন নয়।

জানা গেছে, জামালপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রয়োগ করা ৭৪০টি ইনজেকশন ভায়ালের মধ্যে ৪১টি ভায়ালে ওষুধের পরিমাণ কম ছিল।

চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ আরও কয়েকটি জেলায়ও একই ধরনের অভিযোগ এসেছে।

অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, টেকনো ড্রাগসকে তলব করা হয়েছে এবং তারা ত্রুটিপূর্ণ ভায়ালগুলো তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উদ্যোগ

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু করেছে এবং টেকনো ড্রাগসকে শোকজ নোটিশ পাঠিয়েছে।

তারা জানিয়েছে, ভায়ালগুলোর গুণগত মান পরীক্ষার জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাইফুল্লাহিল আজম জানান, “আমরা মাঠ পর্যায়ে চিঠি পাঠিয়েছি যাতে কম পরিমাণ ওষুধ থাকা ইনজেকশনের প্রয়োগ বন্ধ রাখা হয়।”

তিনি বলেন, “যদি এই ইনজেকশন প্রয়োগের কারণে নারীদের মধ্যে গর্ভধারণের ঘটনা ঘটে, তবে টেকনো ড্রাগসের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সংকট

বাংলাদেশে বর্তমানে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সংকটও চলছে।

মাঠ পর্যায়ে ২৫টি উপজেলায় কোনো ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী নেই এবং ৩২৭টি উপজেলায় ইনজেকশনের মজুত শেষের পথে।

প্রতি মাসে সরকারিভাবে ৬ লাখ ৮০ হাজারের বেশি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়, যা দরিদ্র শ্রেণির নারীদের মধ্যে ব্যাপক ব্যবহৃত।

অধিদপ্তর জানিয়েছে, সংকট নিরসনের জন্য উন্নয়ন বাজেট থেকে সামগ্রী কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

টেকনো ড্রাগসের প্রতিশ্রুতি

টেকনো ড্রাগস লিমিটেড এ বিষয়ে জরুরি বৈঠকে অংশগ্রহণ করে এবং তারা ভুল স্বীকার করেছে।

তারা ত্রুটিপূর্ণ ভায়ালগুলো তুলে নিয়ে নতুন সরবরাহ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

তবে, এই ত্রুটির জন্য প্রতিষ্ঠানটি কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার তাগিদ

প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গর্ভনিরোধক ইনজেকশনের মতো সংবেদনশীল ওষুধ আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে তৈরি ও বিতরণ করা উচিত।

ডা. ফারজানা শারমিন শুভ্রা বলেন, “প্রতিটি ইনজেকশনে নির্দিষ্ট মাত্রায় ওষুধ থাকা জরুরি।”

তিনি আরও বলেন, “যদি এমন ঘটনা বারবার ঘটে, তবে নারীদের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে।”

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রশাসনিক নজরদারি বাড়ানো উচিত।

সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া

সাধারণ মানুষও এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন।

বিরোধী দলগুলোর মতে, এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের অবহেলা দুঃখজনক।

তারা বলছেন, দরিদ্র শ্রেণির নারীদের এই ধরনের ত্রুটিযুক্ত সামগ্রী সরবরাহ করে তাদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর জানিয়েছে, এই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত করা হবে এবং পরবর্তীতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

তারা টেকনো ড্রাগসের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে রাখবে এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা রোধে নতুন নির্দেশিকা জারি করতে পারে।

এই ঘটনা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের মান ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

আরও পড়তে পারেন