আন্দোলনকারী ছাত্র
,

নেতৃত্বে সমন্বয়হীনতা ও বিতর্কের মুখে বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন: সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতা

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ থেকে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের দাবি, ছাত্র আন্দোলনের সিদ্ধান্তে দ্বিধা-বিভক্তি

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়ে উঠেছে এক আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়। দীর্ঘদিন ধরে চলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশজুড়ে ব্যাপক সাড়া জাগালেও, নেতৃত্বের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য নিয়ে ছাত্রদের মধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সংবিধান বাতিলের দাবি থেকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চাওয়া কিংবা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব—এইসব ইস্যুতে ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের অবস্থান ও সিদ্ধান্তের সমন্বয়হীনতার প্রমাণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক মহল, নাগরিক সমাজ এবং বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের সমন্বয়হীনতা ও অস্পষ্টতা আন্দোলনের জনপ্রিয়তা এবং লক্ষ্য অর্জনের পথে বড় বাধা হতে পারে।

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ এবং সংবিধান বাতিল: ছাত্র নেতাদের দাবিতে রাজনৈতিক জটিলতা

ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের প্রথম ইস্যু যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক ও সমালোচনা শুরু হয়, সেটি ছিল সংবিধান বাতিল এবং রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি। বাংলাদেশে সংবিধান পরিবর্তনের দাবিতে এই ছাত্র আন্দোলনের নেতারা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়টি সামনে আনেন। তারা দাবি করেন, দেশের বর্তমান শাসনব্যবস্থার পুনর্গঠন এবং ক্ষমতার কাঠামোতে পরিবর্তন আনার জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ প্রয়োজন।

কিন্তু তাদের এই দাবির মুখোমুখি এসে বিরোধী দল বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল স্পষ্ট করে জানায়, তারা সংবিধান বাতিল কিংবা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের মতো বিষয়ে সমর্থন দিতে ইচ্ছুক নয়। বিএনপি আরও জানায়, তারা এমন কোনো দাবি মেনে নেবে না যা সাংবিধানিক সংকট তৈরি করতে পারে। এর ফলে আন্দোলনের নেতারা একদিকে জনসাধারণের সমর্থন পেতে থাকলেও, রাজনৈতিক মঞ্চে তাদের পক্ষে কোনো ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। অনেকেই এই ইস্যুতে ছাত্র নেতাদের উদ্দেশ্যে এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এর পাশাপাশি, ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে কি না, সেটিও আলোচনায় উঠে এসেছে।

জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলা: নেতাদের ফেসবুক স্ট্যাটাস ঘিরে বিতর্ক

জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলার ঘটনাও নতুন এক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। যখন জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, তখন সেই সময়ে সংগঠনের শীর্ষ দুই নেতা জাতীয় পার্টিকে উৎখাতের আহ্বান জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন। এই ঘটনায় রাজনৈতিক মহলে এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। অনেকেই মনে করেন, এ ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে অক্ষমতা ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের দায়িত্ববোধ এবং নেতৃত্বের অভাবকে প্রমাণ করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদা রওনক খান এই বিষয়ে বলেন, “অভ্যুত্থান এবং দেশ পরিচালনা দুটো ভিন্ন বিষয়। দেশ গঠন এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা আবশ্যক। ছাত্র নেতারা যদি এমন বিতর্কিত মন্তব্য করে চলেন, তাহলে তাদের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে কমতে পারে।” তার মতে, এই ধরনের কর্মকাণ্ড এবং বক্তব্য ছাত্র আন্দোলনের জন্য দীর্ঘমেয়াদে বড় ধাক্কা হতে পারে।

আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের উদ্যোগ: নেতৃত্বের ভেতর সমন্বয়হীনতার স্পষ্ট প্রমাণ

ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ দুই নেতা সাম্প্রতিককালে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার জন্য আদালতে রিট করার উদ্যোগ নেন, যা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। তাদের এই পদক্ষেপে সমন্বয়হীনতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছাত্র আন্দোলনের সাংগঠনিক ফোরামে আলোচনা ছাড়াই এই রিট করার প্রস্তাব আনা হয়, যা দলের অভ্যন্তরে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।

এই রিটের উদ্যোগ নিয়ে আরও একটি বড় বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন নিষিদ্ধের তালিকায় বাম গণতান্ত্রিক জোটের সিপিবি এবং এলডিপি নামক দলগুলোর নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় আন্দোলনের নেতৃত্ব কতটা সমন্বিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সেই প্রশ্ন আরও গভীর হয়ে ওঠে। যদিও পরবর্তীতে বিতর্কের মুখে রিট আবেদন প্রত্যাহার করা হয়, তবে এ ঘটনার ফলে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যকার সমন্বয়হীনতার দিকটি সামনে চলে আসে।

নেতৃত্বের কাঠামোতে পরিবর্তন: চার সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন

আগস্ট মাসে ছাত্র আন্দোলনের জন্য ১৫৮ সদস্যের সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হয়, যা পরবর্তীতে চার সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটিতে রূপান্তরিত হয়। এই আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মূল লক্ষ্য ছিল সারাদেশে আন্দোলনের কার্যক্রমকে ছড়িয়ে দেয়া। আন্দোলনের অন্যতম নেতা আবু বাকের মজুমদার জানান, “আমাদের এক দফার দুটি অঙ্গীকার রয়েছে—ফ্যাসিবাদের বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করা। এর মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছাতে আমাদের একটি কেন্দ্রীয় কাঠামো প্রয়োজন, এবং সেই কাঠামো তৈরির লক্ষ্যেই এই কমিটি গঠন করা হয়েছে।”

তবে এই নতুন কাঠামো গঠনের পরও নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং বিতর্ক কাটেনি। আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পরও বিভিন্ন ইস্যুতে সমন্বয়হীনতা অব্যাহত আছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বিশেষ করে, আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ চেয়ে রিট করার উদ্যোগ এবং এর পরিণাম আন্দোলনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নেতৃত্বের সমন্বয়হীনতা এবং সংগঠনের ভেতরে মতপার্থক্য

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা নেতাদের ভেতরে সম্প্রতি কয়েকটি ইস্যুতে মতপার্থক্য এবং সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে, যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ আলোচনা এবং ঐক্যবদ্ধ মনোভাবের অভাব রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। একটি সাম্প্রতিক টকশোতে একজন ছাত্রনেতার বিতর্কিত বক্তব্য এবং এর কারণে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হয়েছে।

আন্দোলনের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব আরিফ সোহেল এই বিষয়ে বলেন, “সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি হচ্ছে, এবং সকল সদস্যকে সাংগঠনিক জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে। আমাদের পুরনো কাঠামো থেকে নতুন কাঠামোয় আসতে কিছুটা সময় লাগছে। তবে আশা করছি ভবিষ্যতে সবকিছু গুছিয়ে আসবে।”

রাজনৈতিক সমর্থন এবং জনসমর্থন ধরে রাখা: ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হচ্ছে জনসমর্থন ধরে রাখা। একদিকে তাদের রাজনৈতিক ইস্যুতে বিভিন্ন দল এবং গোষ্ঠীর কাছ থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, আবার অন্যদিকে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে।

আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব আরিফ সোহেল মনে করেন যে, ছাত্র আন্দোলনের উদ্দেশ্য এবং দাবির প্রতি জনগণের এখনও আস্থা রয়েছে। তিনি বলেন, “বিএনপি বা অন্য কোনো দল রাষ্ট্রপতির অপসারণে ভিন্নমত পোষণ করলেও এটি আমাদের জন্য কোনো ধাক্কা নয়। বরং, এটি সংলাপের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে।” তার মতে, ছাত্র আন্দোলন সামগ্রিকভাবে দেশকে নতুনভাবে গড়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা এবং বিভাজন আন্দোলনের জনপ্রিয়তায় প্রভাব ফেলতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, নেতৃত্বের মধ্যে ঐক্যের অভাব এবং বিভিন্ন ইস্যুতে মতপার্থক্য এই আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বৃহত্তর ঐক্য ও নেতৃত্বের সংকট

সর্বমোট পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এখন দ্বন্দ্ব, মতপার্থক্য, এবং সমন্বয়হীনতা প্রকটভাবে বিদ্যমান। যদিও শীর্ষ নেতারা ঐক্যের কথা বলছেন, বাস্তবে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য এবং ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা বিদ্যমান। এ ধরনের বিভাজন এবং সমন্বয়হীনতা ছাত্র আন্দোলনের বৃহত্তর ঐক্যের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং জনসাধারণের সমর্থন ধরে রাখার পথে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন নেতৃত্বের সমন্বয়হীনতা এবং বিভাজনের কারণে ক্রমেই বিতর্কিত হয়ে উঠছে। সংবিধান বাতিল, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনের অভ্যন্তরে বৈপরীত্যের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। যদিও আন্দোলনের নেতারা বৃহত্তর ঐক্যের কথা বলে থাকেন, বাস্তবে আন্দোলনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং নেতৃত্বের সংকট রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই সমন্বয়হীনতা এবং নেতৃত্বের সংকট দীর্ঘমেয়াদে আন্দোলনের জনপ্রিয়তায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

আসন্ন দিনগুলোতে এই ছাত্র আন্দোলন কি নতুন নেতৃত্বের কাঠামো ও কার্যক্রম নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে, নাকি তাদের এই বিভাজন তাদের সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, সেটিই এখন সময়ের অপেক্ষা।

আরও পড়তে পারেন