ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে সংশয় ও সম্ভাবনার জটিলতা
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নানা রকম আলোচনা হচ্ছে, বিশেষত বাংলাদেশে। ট্রাম্পের জয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন রূপে আবির্ভূত হতে পারে বলেই মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।
গত বছরগুলোতে মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে তার ছবি এই উষ্ণ সম্পর্কের প্রমাণ দেয়।
তবে ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন কীভাবে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে, তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। যদিও ইউনূস প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথেও তাদের সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে।
ট্রাম্পের সাথেও ইউনূসের সম্পর্কের সম্ভাবনা আছে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে অধ্যাপক ইউনূসের সম্পর্ক নিয়ে কিছুটা দ্বিধা থাকলেও সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। প্রধানমন্ত্রী ইউনূস ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, তিনি দুই দেশের মধ্যে টেকসই উন্নয়নে কাজ করতে আগ্রহী।
তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসায় বাংলাদেশের ওপর বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদে কিছু প্রভাব পড়তে পারে।
২০১৬ সালের নির্বাচনের পর, যখন প্রথমবার ট্রাম্প ক্ষমতায় আসেন, ইউনূস তাকে সমালোচনা করে বলেছিলেন এটি এক ধরনের অন্ধকার সময়। এই মন্তব্যের পর থেকেই ট্রাম্পের সাথে ইউনূসের সম্পর্ক নিয়ে কিছুটা সংশয় দেখা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় লবির প্রভাব
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ভারতীয় লবির প্রভাব বাংলাদেশের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মার্কিন রাজনীতিতে ভারতীয় লবির শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে, যা অনেক সময় বাংলাদেশের জন্য চাপের কারণ হতে পারে।
সম্প্রতি এক টুইটে ট্রাম্প বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে মন্তব্য করেন, যা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সরকারকে কিছুটা চাপে ফেলে দেয়। অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ভারতীয় লবির শক্তি এ ধরনের টুইটে প্রতিফলিত হয়।
বাংলাদেশের কিছু রাজনীতিক মনে করছেন, ট্রাম্প প্রশাসন ভারতীয় লবির প্রভাবে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে।
ভারত-মার্কিন সম্পর্ক ও তার প্রভাব
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্ক বরাবরই ঘনিষ্ঠ। ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের পর মোদি তাকে বন্ধু বলে অভিহিত করেছেন। এই ঘনিষ্ঠতা বাংলাদেশের জন্য আশঙ্কার কারণ হতে পারে, কারণ ভারত আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মিত্র।
আওয়ামী লীগ সরকারকে সহযোগিতা করে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার জন্য ভারত প্রভাব খাটাতে পারে, এবং সেই প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের সহায়তা আদায় করতে পারে।
চীনের প্রসঙ্গ ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ভূমিকা
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি চিন্তা না করে, বরং ভারত ও চীনের প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত নেয়।
যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের চীন-বিরোধী অবস্থান প্রবল, এবং বাংলাদেশ চীনের সাথে অনেক ক্ষেত্রেই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে, সেহেতু ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের প্রতি কৌশলগতভাবে তেমন ইতিবাচক মনোভাব রাখবে না বলে মনে করা হচ্ছে।
অধ্যাপক রীয়াজের মতে, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং ট্রাম্পের অধীনে এটি আরও প্রভাবিত হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব
ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা নিয়েও বিশ্লেষকরা মতবিনিময় করছেন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং রপ্তানি খাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
তবে, ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি সাধারণত আমেরিকা-কেন্দ্রিক এবং অন্যান্য দেশের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রবণতা রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য ঝুঁকি রয়েছে যে, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের বাণিজ্যের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী?
অধ্যাপক আলী রীয়াজের মতে, ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের পর বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক হঠাৎ নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হবে না। তবে সামগ্রিক সম্পর্কের উষ্ণতায় কিছুটা ভাটা পড়তে পারে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ যদি কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে চায়, তবে তাদেরকে চীনের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির বলেন, মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল রাখতে আগ্রহী, কারণ স্থিতিশীল বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উপকারী।
সামগ্রিক বিশ্লেষণ
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য একাধিক চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে আসছে। ভারত-মার্কিন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, ভারতীয় লবির প্রভাব, এবং চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে বাংলাদেশের কৌশলগত পদক্ষেপ ও দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগের উপর।