জাতীয় সংস
,

সংবিধান সংশোধন: ম্যান্ডেট ও এখতিয়ার নিয়ে বিতর্কে উত্তপ্ত রাজনৈতিক অঙ্গন

সংবিধান সংশোধনের ম্যান্ডেট নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কে বিভক্ত বিএনপি-জামায়াত ও ক্ষমতাসীন দল

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সংবিধান সংশোধনের ম্যান্ডেট নিয়ে বিতর্কের জেরে।

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য মাহফুজ আলমের একটি বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

তার মতে, সরকারই সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে এবং এক দফা ঘোষণার মাধ্যমে বর্তমান সংবিধান কার্যত বাতিল হয়েছে।

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এ বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে বলছে, সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখনের এখতিয়ার শুধুমাত্র জাতীয় সংসদের, বর্তমান সরকারের নয়।

এদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও বিভিন্ন অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের কোন কোন অংশ সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে, সেই দিকেই তারা নজর দিচ্ছেন।

মাইনাস-টু এবং নতুন সংবিধান সংক্রান্ত বিতর্ক

মাহফুজ আলমের মন্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য হলো, “এক দফা ঘোষণার দিনই সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে।”

তাঁর মতে, এক দফা ঘোষণাপত্রে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার অর্থই হলো নতুন সংবিধানের প্রয়োজন।

এ নিয়ে তর্ক বাড়ছে, কারণ বিরোধীদলগুলো মনে করে সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুতর পদক্ষেপে নির্বাচিত সংসদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো উদ্যোগের আইনগত ভিত্তি নেই।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, “এটি শুধুমাত্র নির্বাচিত সংসদের এখতিয়ার; বর্তমান সরকারের অধীনে এ ধরনের পদক্ষেপ কার্যকর করার কোনো বৈধতা নেই।”

জামায়াতে ইসলামীও একই সুরে জানিয়েছে যে, সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে জাতীয় সংসদের বাইরে অন্য কোনো ফোরামের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার নেই।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম ও সুপারিশ বাস্তবায়নের জটিলতা

সংবিধান সংস্কার কমিশন ইতিমধ্যেই অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে কার্যক্রম শুরু করেছে।

তাদের লক্ষ্য হলো, জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও বিভিন্ন অংশীজনের পরামর্শ নিয়ে সংবিধানের সংশোধন, সংযোজন এবং পুনর্লিখনের প্রয়োজনীয় অংশগুলো চিহ্নিত করা।

কমিশন ঘোষণা করেছে যে আগামী সপ্তাহ থেকে সিভিল সোসাইটি এবং অন্যান্য অংশীজনদের সাথে আলোচনা শুরু হবে।

এদিকে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন কিভাবে করা হবে, তা নিয়ে বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।

কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, বর্তমান সরকারের অধীনে সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তা রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।

আন্দোলনকারীদের দাবি ও রাজনৈতিক সমর্থন

সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে উদ্ভূত হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে এক দফা দাবি ঘোষণা করা হয়, যার ভিত্তিতে বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগের দাবি উঠে এসেছে।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে নাহিদ ইসলাম এক দফা দাবির ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

ঘোষণাপত্রে সরকারের পদত্যাগের দাবি জানানো হয়, যেখানে উল্লেখ করা হয় বর্তমান সরকারের কার্যক্রম গণতন্ত্রের ভিত্তি নষ্ট করছে এবং তারা বিশ্বাস করেন এই সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ বিচার বা তদন্ত সম্ভব নয়।

এই ঘোষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করেই বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংবিধানের পুনর্লিখনের দাবি উঠেছে।

সংবিধান সংস্কার নিয়ে আইনজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত

সংবিধান সংশোধনের ম্যান্ডেট নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, “সংবিধান সংশোধন সংসদের এখতিয়ার। সংবিধান পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে এই ধরনের অস্থিরতা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে আরও ঝুঁকিতে ফেলবে।”

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেন বলেছেন, সংবিধানের পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন হতে পারে, তবে তা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা হওয়া উচিত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ বিষয়ে বিরোধী দলগুলোর প্রতিক্রিয়া ও সরকারের বক্তব্যকে বিবেচনা করলে রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে।

‘গণতান্ত্রিক সংস্কার’ ও বিএনপির অবস্থান

বিএনপি তাদের নিজস্ব প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সামনে উপস্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বিএনপির নেতৃবৃন্দ বলছেন, তারা গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল সংবিধান চান যা জনগণের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

সালাউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “আমরা আমাদের প্রস্তাবনা গুলো নিয়ে কাজ করছি। সেগুলো চূড়ান্ত করে আমরা সংস্কার কমিশনে জমা দিবো। এর মধ্য দিয়ে আমরা জাতির সামনে আমাদের প্রতিশ্রুতি রাখবো।”

জামায়াতে ইসলামী মনে করে, সংবিধানের কোনো সংস্কার বা পুনর্লিখনের সিদ্ধান্ত জনগণের নির্বাচিত সংসদের অধীনে হতে হবে।

সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ

মাহফুজ আলমের বক্তব্যের পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা বেড়েছে, এবং পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।

বিরোধী দলগুলো একত্রে সরকারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে দাবি জানাচ্ছে যে, সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রস্তাব বা সুপারিশ শুধুমাত্র সংসদের অধীনে বাস্তবায়িত হতে হবে।

সরকার পক্ষ থেকে এখনো এই বিতর্ক নিয়ে কোনো পরিষ্কার অবস্থান ব্যক্ত করা হয়নি, তবে বিভিন্ন মহল মনে করে, নির্বাচনের আগে এই বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানো হতে পারে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ, বিরোধী দলের মতামত এবং সরকারপক্ষের প্রতিক্রিয়া নিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে নতুন দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

বহুমাত্রিক এই বিতর্ককে ঘিরে, রাজনৈতিক অঙ্গন এবং সাধারণ জনগণও এখন প্রহর গুনছে পরবর্তী পদক্ষেপের, যা হয়তো বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

আরও পড়তে পারেন