বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি মাইনাস-টু ফর্মুলা নিয়ে তার সতর্কবার্তা প্রকাশ করেছেন। ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তার এই বক্তব্যের পর থেকে দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। তিনি বলেছেন, অতীতে বিরাজনীতিকরণ বা মাইনাস-টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের যে চেষ্টা করা হয়েছিল, সেটি আবারও পুনরুজ্জীবিত হতে পারে। তার এ বক্তব্য দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে শঙ্কা তৈরি করেছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাদের নেতৃত্বকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। দলটির নেতারা বলছেন, ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে বিরাজনীতিকরণের প্রচেষ্টা হয়েছিল, যেটি মাইনাস-টু ফর্মুলা নামে পরিচিতি পায়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি আবারও এমন শঙ্কায় রয়েছে যে তাদের নেতৃত্বকেও রাজনীতির বাইরে ঠেলে দেওয়া হতে পারে।
বিরাজনীতিকরণের শঙ্কা কেন?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজনীতিকরণের প্রসঙ্গ কোনো নতুন বিষয় নয়। ২০০৭ সালে, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুই নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সে সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিরাজনীতিকরণ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয় এবং এই দুই শীর্ষ নেত্রীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার প্রয়াস দেখা যায়। কিন্তু পরবর্তীতে এ প্রচেষ্টা সফল হয়নি, এবং দুই নেত্রীই রাজনীতিতে ফিরে আসেন।
বিএনপি মনে করছে, বর্তমান সরকারও বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক মাঠকে শূন্য করার চেষ্টা করছে। এই প্রসঙ্গে, মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে এমন একটি বার্তা রয়েছে যে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকেও হয়তো একইভাবে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে একটি প্রচেষ্টা চলছে।
সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে
সরকারের এক উপদেষ্টা সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, মাইনাস-টু ফর্মুলা বর্তমান সরকারের কোনো এজেন্ডায় নেই। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে সরকারের কিছু কর্মকাণ্ড এবং কিছু উচ্চপদস্থ ব্যক্তির মন্তব্যে বিরাজনীতিকরণের একটি আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের জানান, “নির্বাচন সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলেও নির্বাচনের আগে কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন।” এমন মন্তব্যে বিএনপির কিছু নেতারা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এসব সংস্কার আসলে নির্বাচনের আগের প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করার একটি অজুহাত হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, “দেশের বাস্তবতায় বিএনপি এখনো সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। তাই কোন কিছু করতে হলে বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই করতে হবে।” তার এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, বিএনপি মনে করছে তাদের বাদ দিয়ে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক পদক্ষেপ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আন্দোলন
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে দেশের একটি কার্যকর ও স্বচ্ছ নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির দাবি জানিয়ে আসছে। দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের কাছে আবারও দেশের ভবিষ্যৎ তুলে দেওয়ার জন্য নির্বাচনের ওপর জোর দিচ্ছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আমরা বাংলাদেশকে হাসিনামুক্ত করার জন্য কাজ করেছি। জীবন দিয়েছি, প্রাণ দিয়েছি। এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দ্রুত নির্বাচন দাবি করছি।”
বিএনপির এ আন্দোলন শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের স্বার্থের জন্য নয় বরং দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য, এমনটাই দাবি দলের নেতাকর্মীদের। মির্জা ফখরুল বলেন, “সরকার দ্রুত নির্বাচন না দিলে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হবে এবং জনগণের আস্থা হারাবে।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নতুন রাজনৈতিক গতি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ জানান, তারা সবাইকে নিয়ে রাজনীতি করতে চান এবং বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোনো রাজনীতি করার প্রশ্নই আসে না। তিনি বলেন, “আমরা সবাইকে নিয়ে রাজনীতি করতে চাই। বিএনপিকে বাদ দেওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই।”
এদিকে এই আন্দোলনের কর্মকাণ্ড, নতুন দল গঠনের আলোচনা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার মধ্যে মাইনাস-টু ফর্মুলার প্রসঙ্গ আরও জোরালো হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, সরকার এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারের ওপর বেশি জোর দেওয়ায় বিএনপির মধ্যে নতুন করে মাইনাস-টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের আশঙ্কা বেড়েছে।
আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থা ও রাজনৈতিক অবস্থান
গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতা বিদেশে চলে গেছেন বা আত্মগোপনে রয়েছেন। দলের বেশ কয়েকজন নেতা, যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি নেতারা মনে করছেন, তাদেরও একইভাবে রাজনীতির ময়দান থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, বিএনপি নেতাদের বিষয়ে সরকারি উপদেষ্টা ও বিভিন্ন ছাত্রনেতার ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য তাদের শঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা এবং নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন
সরকার ইতিমধ্যেই সংবিধান সংস্কারসহ বেশ কিছু প্রশাসনিক সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তবে বিএনপি নেতারা বলছেন, এসব সংস্কারের নামে আসলে নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে পিছিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বিএনপির নেতারা আরও উল্লেখ করেছেন যে, সরকার ঘনিষ্ঠ ছাত্রনেতারা বিএনপির বিরোধিতা করে বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন, যা তাদেরকে দুর্বল করার একটি প্রচেষ্টা হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক মামুন আল মোস্তফা বলছেন, “বিএনপি মনে করছে, সংস্কারের নামে তাদেরকে ক্ষমতায় আসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এটি একটি বড় রাজনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে।”
দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের দাবি, দেশের জন্য একটি স্থায়ী ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে দ্রুত নির্বাচনের প্রয়োজন। বিএনপি নেতারা বলছেন, যদি দেশে দ্রুত নির্বাচন না হয় তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বৃদ্ধি পাবে এবং এর ফলে দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দুর্বল হবে।
তাদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার যদি ‘বিরাজনীতিকরণের’ পথে হাঁটে, তবে জনগণের সমর্থন হারাবে। মির্জা ফখরুল বলেন, “গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচনই একমাত্র পথ। আমাদের নেতৃত্ব বাদ দিয়ে কোনো প্রক্রিয়া দেশের জন্য ভালো হবে না।”
নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশের দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা উচিত। তিনি সতর্ক করে বলেন, “দ্রুত নির্বাচন না হলে, রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকারকে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।”
বিএনপির পক্ষ থেকে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের বিষয়ে এখনো সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা না আসায় রাজনৈতিক অঙ্গনে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।