ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের জন্য নেই কোনো জায়গা
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ট্রাইব্যুনালের রায় না হওয়া পর্যন্ত ভারতে অবস্থানরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চাওয়া হবে না।
ইউনূসের এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, বর্তমান প্রশাসন কূটনৈতিক উত্তেজনা এড়াতে এখনই ভারতের কাছে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চাইতে আগ্রহী নয়।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুনর্বিন্যাসের জন্য বর্তমান সময়টিতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে থাকার প্রয়োজন নেই।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে “ফ্যাসিজমের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শনের জন্য” দায়ী করে ইউনূস বলেন, দেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিস্ট পার্টির কোনো স্থান থাকা উচিত নয়।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল হিসেবে উল্লেখ করা হলেও, ছাত্র-নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা গত আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হয়।
ভারতের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় ‘কৌশলী অপেক্ষা’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই অধ্যাপক ইউনূস ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন এবং উত্তেজনা হ্রাসের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি বলেছেন, ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চাওয়া হবে না।
এই অবস্থান ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন কমানোর একটি কৌশল হতে পারে বলে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইউনূসের মতে, শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে ভারতের সাথে কূটনৈতিক উত্তেজনা এড়ানো সম্ভব।
শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, তার মায়ের বিরুদ্ধে আনা সহিংসতার অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তিনি জানান, শেখ হাসিনা যে কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে প্রস্তুত আছেন এবং বেআইনি কিছু করেননি।
“গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফ্যাসিস্ট দলের স্থান নেই”
ইউনূস বলেন, আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য জনগণ এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
তার মতে, দলটি জনগণের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করেছে এবং গণতন্ত্রের জন্য একটি বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউনূসের মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এমন কোনো দল থাকা উচিত নয় যারা নিজেদের স্বার্থে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
ট্রাইব্যুনালের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।
ইউনূস বলেন, তার সরকার ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ভারতের সাথে প্রত্যর্পণ চুক্তির মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
তার মতে, বিচার কার্যক্রম শেষ হওয়ার আগে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
শেখ হাসিনার দলকে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জ’
শেখ হাসিনার উৎখাতের পর থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুনর্গঠনের জন্য নতুন পরিকল্পনা করছে ইউনূসের অন্তর্বর্তী প্রশাসন।
বর্তমান সরকার ১০টি কমিশন গঠন করেছে যাদের মূল কাজ বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করা।
“রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোকেই নিতে হবে”
আওয়ামী লীগ নিয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা ইউনূসের সরকারের নেই বলে তিনি জানান।
ইউনূস বলেন, তাদের প্রশাসন একটি রাজনৈতিক সরকার নয় এবং আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত রাজনীতিতে কোনো ভূমিকা রাখবে কি না, তা রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।
তিনি বলেন, “তাদের রাজনৈতিক স্পেসের বিষয়ে তাদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ নিয়ে দেশে যে বিতর্ক চলছে, তার মধ্যে এটিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, আওয়ামী লীগ যদি নিজেদের মধ্যে সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে দলটির ভবিষ্যতে আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া সম্ভব।
শেখ হাসিনার অবস্থান: অনিশ্চয়তা
শেখ হাসিনা ভারতে কোথায় অবস্থান করছেন তা স্পষ্ট নয়।
তবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানান, তাদের দল যেকোনো নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত।
তিনি ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে পুনরায় সক্রিয় হওয়ার জন্য প্রস্তুত।
ভারতের সাথে সম্পর্কের অগ্রাধিকার
ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ এবং ভারত পারস্পরিক নির্ভরশীল দুটি প্রতিবেশী দেশ এবং তাদের সম্পর্ক সর্বোচ্চ ভালো থাকার প্রয়োজন।
তিনি উল্লেখ করেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের সাথে সহযোগিতা বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশ সফরে আসার আমন্ত্রণ জানান এবং বলেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে তাদের সম্পর্ক উন্নয়ন করা উচিত।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং ভারতের উদ্বেগ
ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
অভ্যুত্থানের পর থেকে কিছু হিন্দু আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ইউনূস বলেন, “অল্প সংখ্যক হিন্দু আওয়ামী লীগের সমর্থক হওয়ায় আক্রমণের শিকার হয়েছেন, তবে তারা ধর্মের কারণে নয়, রাজনৈতিক কারণে টার্গেট হয়েছেন।”
কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রভাব
শেখ হাসিনার উৎখাতের পর ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে।
শেখ হাসিনার সরকার ভারতের একটি প্রধান মিত্র ছিল এবং বর্তমানে বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনকে নিয়ে ভারতের মধ্যে কিছু অসন্তোষ রয়েছে।
ইউনূস বলেন, তারা ভারতকে পাশে রাখার চেষ্টা করছেন এবং এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শেখ হাসিনার ভবিষ্যত: বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ভবিষ্যত নিয়ে বিতর্ক চলছে।
ইউনূসের মন্তব্যে স্পষ্ট যে, তার অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছে।
তবে ট্রাইব্যুনালের রায়ের অপেক্ষায় থাকায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিষয়ে আরও সতর্কতা অবলম্বন করছে তারা।
এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।