বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
, ,

হাসিনা সরকারের পতনের পর বিপাকে ছাত্রলীগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চোখে ‘সন্ত্রাসী’

ছাত্র আন্দোলনের ঢেউয়ে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা, বিপর্যয়ের মুখে প্রাক্তন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের প্রভাবশালী ছাত্র নেতা ফাহমি, যিনি ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে বিস্তৃত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন প্রভাব বিস্তার করে এসেছেন, এখন নিজেকে আত্মগোপনে রেখেছেন।

২৪ বছর বয়সী ফাহমি ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (বিএসএল) একজন কেন্দ্রীয় নেতা। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে তিনি দলীয় সমর্থন নিয়ে রাজনীতি চালিয়ে গেলেও ছাত্র আন্দোলনের ফলে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর তাঁর জীবন যেন রাতারাতি পাল্টে যায়।

আন্তর্জাতিক চাপ, নাগরিক অসন্তোষ ও ছাত্রদের চলমান আন্দোলনের জেরে হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে দলটির ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগও মুখ থুবড়ে পড়ে।

আগস্টে ঘটে যাওয়া এই আন্দোলনের পর হাসিনা নিজেও ভারত পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, আর তার শাসনামলে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের সদস্যরা আজ প্রতিপক্ষের আক্রমণের শিকার হয়ে কেউ গা-ঢাকা দিয়েছেন, কেউবা গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ, সমাজে প্রতিহিংসার মুখে নেতারা

বুধবার, বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসন ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করে এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে।

বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালিত হচ্ছে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের ইতিহাসে সহিংসতা, হয়রানি, এবং দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

ফাহমি, যিনি এক সময় ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে প্রভাব বিস্তার করতেন, এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

“কিছুদিন আগেও আমি এখানকার একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলাম,” আল জাজিরাকে বলছিলেন ফাহমি। “এখন আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত আমি, কারণ একটি দল আমাকে যে সম্মান ও ক্ষমতা দিয়েছিল, আজ তা আমাকে বিপদের মুখে ফেলে গেছে।”

ছাত্র আন্দোলনের উত্থান এবং হাসিনার নির্বাসন

জুলাই মাসে সরকারের বিতর্কিত কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করলে সরকার তা দমন করতে চায়, যা পরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়।

আদালতের আদেশে কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হয়, কিন্তু সেই আন্দোলন দেশের বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়।

নিরাপত্তা বাহিনী তখন সহিংস পদ্ধতিতে প্রতিবাদ দমনের চেষ্টা চালায়।

ক্যাম্পাসের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে টিয়ার গ্যাস, গুলি চালনা এবং নির্মম প্রহারের মতো ঘটনা ঘটে, যার ফলে হাজারেরও বেশি লোকের মৃত্যু ঘটে এবং হাজার হাজার মানুষ গ্রেপ্তার হয়।

দেখতে দেখতে এই বিক্ষোভ বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ে পরিণত হয়।

ছাত্রলীগের প্রভাব ধসে পড়া এবং নতুন প্রতিপক্ষের জন্ম

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নিজেরাই সমাজের চক্ষুশূল হয়ে পড়েন।

প্রতিশোধস্পৃহার শিকার হয়ে অনেক ছাত্রলীগ সদস্য আক্রমণের মুখে পড়েন।

ফাহমির মতো অনেকের বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়।

“আমার পরিবারকে সরাসরি হুমকি দেয়া হয়েছে,” তিনি বলেন। “আমার ছোট ভাইকে গুম করার হুমকি দেয়া হয়েছিল।”

ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের ক্ষমতা বিলীন হওয়া এবং সামগ্রিক ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা

বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অন্তত ৫০,০০০ ছাত্রলীগ সদস্য তাদের উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারছেন না।

এই পরিবর্তনের ফলে অনেক ছাত্র নেতা এক ভয়াবহ অনিশ্চিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শাহরিন আরিয়ানা ও সহপাঠী সাইফুল রাইহানকে পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে গ্রেপ্তার করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, অন্যান্য ছাত্ররা তাদের সাথে বসতে রাজি ছিল না, ফলে পরিস্থিতি আরো অবনতি রোধে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে তাদের পরীক্ষা দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে।

মিথ্যা অভিযোগ এবং হয়রানির অভিযোগে বিপর্যস্ত প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতারা

ক্যাম্পাসের প্রভাব বিস্তারের জন্য এবং ক্ষমতার বলয়ে থাকার প্রলোভনে ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত অনেক শিক্ষার্থীরা এখন বিচারবহির্ভূত অভিযোগ এবং হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

সরকারি ঘোষণার প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

যে ছাত্ররা একসময় ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন, আজ তাদেরকে নিজেদের শিক্ষাগত ভবিষ্যত নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে।

প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাহমি বলেন, “আমি দেশের সেবা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এখন আমি নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত।”

বিরোধী দলের প্রভাব এবং নতুন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

আওয়ামী লীগের এক সময়ের বিরোধী দল ছাত্রদল এবং ইসলামী ছাত্রশিবির আবার ক্যাম্পাসে শক্তি সংগ্রহ করছে।

দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত, প্রতিহত এবং অনেক ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবির, এখন নিজেদের হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ছাত্রশিবিরের ঢাবি ইউনিটের সভাপতি আবু শাদিক বলেন, “ছাত্রলীগ একটি আধুনিক দাসত্ব ব্যবস্থা চালু করেছিল। বেঁচে থাকতে হলে ছাত্ররা তাদের সাথে যুক্ত হতে বাধ্য হতো। তাদের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করেছে, তাদের জীবনে অমানবিক অত্যাচার চালানো হয়েছে।”

প্রাক্তন নেতাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ এবং সমাজে পুনঃস্থাপনের সম্ভাবনা

প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুজন, বলেন, “আমার প্রজন্ম শুধু আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় দেখতে পেয়েছে। তাই, ছাত্রলীগে যোগদান করার বাইরে কোনো বিকল্প ছিল না।”

তিনি যোগ করেন, “যারা আমাদের মতো রাজনৈতিক পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, তাদের জীবন এখন আগের মতো নেই। শিক্ষার্থীরা আমাদের প্রতি যে ঘৃণা প্রকাশ করছে, তা আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া প্রতিশোধের দায়।”

তবে সোজাসুজি ক্ষমা চেয়ে নিজেদের দোষ স্বীকার করার জন্য অনেকেই অনুরোধ করছেন, যাতে সমাজ তাদেরকে পুনরায় গ্রহণ করতে পারে।

ছাত্রলীগের প্রাক্তন সদস্যদের মধ্যে যারা অতীতের সহিংসতার অংশ ছিলেন না বা নীরব দর্শক হিসেবে কাজ করেছিলেন, তারা এখন সমাজে নিজেদের ভূমিকা এবং ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চিত রয়েছেন।

মানবাধিকার এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি

নতুন সরকার দাবী করেছে যে, তারা নতুন প্রজন্মের জন্য একটি বৈষম্যহীন ও সহিংসতামুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়।

ক্যাম্পাসে যারা সহিংসতায় লিপ্ত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাবি প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর বলেছেন, “ক্যাম্পাসে সহিংসতা রোধে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। সকল শিক্ষার্থীর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার অধিকার রয়েছে, কিন্তু কেউ যদি সহিংসতায় যুক্ত থাকে, তবে তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।”

ফলস্বরূপ, ছাত্রলীগের প্রাক্তন নেতারা এখন নিজেদের জীবন ও শিক্ষা নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন।

যেখানে একসময় তারা ক্ষমতায় ছিল, আজ সেখানে তাদের বেঁচে থাকার জন্য আত্মগোপনে যেতে হচ্ছে।

এভাবে একটি সরকার যখন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়, তখন তার প্রভাব শুধুমাত্র রাজনৈতিক অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ে।

আরও পড়তে পারেন