বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান
,

ভুয়া প্রতিবেদন: ওয়াশিংটন পোস্ট সেনা কর্মকর্তাদের বরখাস্তের খবর প্রকাশ করেনি

তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদন

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভুয়া সংবাদের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের নাম ও লোগো ব্যবহার করে দাবি করা হয়, বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ও জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের বরখাস্তের তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে। তবে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট এমন কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি বলে নিশ্চিত করেছে তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার।

এই ভুয়া প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেনাবাহিনীতে একটি বড় ধরনের পুনর্গঠন শুরু করেছেন। এতে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানসহ ৬৭ জন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা এবং ৩,৮৭২ জন সামরিক কর্মী বরখাস্তের তালিকায় রয়েছেন। তবে, তথ্য যাচাইয়ে জানা যায়, এই প্রতিবেদনের কোনো ভিত্তি নেই এবং এটি সম্পূর্ণ বানোয়াট।

ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপট

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া স্ক্রিনশটে দাবি করা হয়, আমেরিকান সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জ্যাকলিন আলেমানি দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের জন্য এই প্রতিবেদনটি লিখেছেন। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন এবং তার জায়গায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।

প্রতিবেদনের দাবি অনুযায়ী, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার সেনাবাহিনীতে পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে বিপুল সংখ্যক সেনা কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানসহ ৬৭ জন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা এবং আরও ৩,৮৭২ জন সামরিক কর্মী।

ফেসবুক, টুইটার, এবং অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে এই খবর ব্যাপকভাবে শেয়ার হতে শুরু করে। অনেকে এই খবরকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে মন্তব্য করতে থাকেন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষিতে এটি আরও বেশি আলোচিত হয়ে ওঠে।

রিউমার স্ক্যানারের ফ্যাক্ট চেক

রিউমার স্ক্যানারের তথ্য যাচাইকারী দল এই প্রতিবেদনটির সত্যতা যাচাইয়ে মাঠে নামে। তাদের অনুসন্ধানে দেখা যায়, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট এমন কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। এছাড়া, সেনাপ্রধান ও জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের বরখাস্তের তালিকা চূড়ান্ত করার মতো কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি।

প্রথমে, রিউমার স্ক্যানারের দল দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের ওয়েবসাইট এবং আমেরিকান সাংবাদিক জ্যাকলিন আলেমানির লেখক প্রোফাইল খতিয়ে দেখে। সেখানে এমন কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। এরপর, তারা দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোপ্রধান গেরি শিহের সঙ্গে যোগাযোগ করে। গেরি শিহ নিশ্চিত করেন যে, এই প্রতিবেদনটি ভুয়া এবং দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট এ ধরনের কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি।

বিশেষজ্ঞদের মতামত ও প্রভাব

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ধরনের ভুয়া সংবাদ প্রচার রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ানোর একটি উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর পুনর্গঠনের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে ভুল তথ্য প্রচার করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, সেনাবাহিনীকে নিয়ে এ ধরনের ভুয়া সংবাদ ছড়ালে তা দেশের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এছাড়া, সেনাবাহিনীর ভেতরে এবং রাজনৈতিক মহলে এই ধরনের তথ্য ভুল বোঝাবুঝি এবং উত্তেজনা বাড়াতে পারে।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের অবস্থান

রিউমার স্ক্যানার দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের সঙ্গে আরও বিস্তারিত তথ্য জানতে ই–মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। তবে প্রতিবেদনটি প্রকাশের সময় পর্যন্ত দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

এদিকে, রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে ফ্যাক্ট চেকের এই তথ্য শেয়ার করে এবং মানুষকে ভুয়া সংবাদ থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানায়।

ভুয়া প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভুয়া সংবাদটি ছড়ানোর পেছনে একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে ভুয়া খবর তৈরি করে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা হতে পারে। রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এই ধরনের সংবাদ ছড়ালে তা দেশের সামরিক এবং বেসামরিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ভুয়া প্রতিবেদনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরি করা হয়েছে। এতে একদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর ভেতরে বিভাজন সৃষ্টি করার চেষ্টা থাকতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া খবর ছড়ানোর ঝুঁকি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া খবর ছড়ানোর ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে ভুয়া তথ্য সহজেই ছড়িয়ে পড়ে এবং তা দ্রুত মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।

সাম্প্রতিককালে ফেসবুক, টুইটারসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোতে ভুয়া খবর চিহ্নিত করার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে তার পরেও, ভুয়া খবর সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।

সতর্ক থাকার আহ্বান

রিউমার স্ক্যানারের এই ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া খবর থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি, সেনাবাহিনীসহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রচার করার বিপদ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ভবিষ্যতে তথ্য যাচাইয়ের প্রয়োজন

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুয়া খবর চিহ্নিত করতে এবং জনগণকে সতর্ক করতে তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তারা পরামর্শ দিচ্ছেন, সংবাদ মাধ্যম এবং সাধারণ মানুষকে আরও সতর্ক থাকতে হবে এবং যে কোনো সংবেদনশীল তথ্য পাওয়ার পর তা যাচাই করতে হবে।

তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে রিউমার স্ক্যানারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তাদের ফ্যাক্ট চেকের মাধ্যমে ভুয়া খবরের সত্যতা উন্মোচিত হলে, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে এবং ভুল তথ্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না।

আরও পড়তে পারেন