ছিনতাই
,

রাজধানী ঢাকায় ছিনতাইয়ের দৌরাত্ম্য: দিনে-রাতে চলছে আতঙ্ক

রাজধানীজুড়ে ছিনতাইকারীদের বেপরোয়া তাণ্ডব, পুলিশের মনোবলে ধস

রাজধানী ঢাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। দিনের আলো থেকে রাতের আঁধার—প্রত্যেক মুহূর্তে ছিনতাইকারীরা সাধারণ নাগরিকদের আতঙ্কিত করছে। অটোরিকশা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নগদ অর্থ, পথচারী এবং যাত্রীদের কাছে থাকা মূল্যবান জিনিসগুলো ছিনিয়ে নিচ্ছে সশস্ত্র ছিনতাইকারীরা। এসব ঘটনা ক্রমাগত আতঙ্ক বাড়াচ্ছে এবং প্রাণঘাতী ছিনতাইয়ের ঘটনাও অহরহ ঘটছে।

পথচারীদের ছাড়াও গণপরিবহনে বসে থাকা যাত্রীদের কাছ থেকে মোবাইল, ব্যাগ, ল্যাপটপ এবং অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্রগুলো। ছিনতাইকারীরা দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে নির্দ্বিধায় এইসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।

পুলিশের উপর আস্থা হারিয়েছে জনগণ

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, এবং রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের কারণে জনগণের কাছে পুলিশের প্রতি আস্থা হ্রাস পায়। এর ফলে জনসাধারণ এবং পুলিশের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।

বিক্ষুব্ধ জনগণ থানায় হামলা চালায়, অগ্নিসংযোগ করে এবং পুলিশের উপর আক্রমণ চালায়। এমনকি অনেক পুলিশ সদস্যকেও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এসব ঘটনায় পুলিশের মনোবলে ধস নামে এবং তারা স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরে যায়। ফলে ঢাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে অপরাধ কার্যক্রম বেড়ে যায়।

ঢাকার বেপরোয়া ছিনতাইকারীরা

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) গত বছরে একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করেছে যেখানে দেখানো হয়েছে, রাজধানীতে ছয় হাজারের বেশি ব্যক্তি ছিনতাই এবং ডাকাতির সাথে জড়িত। এর মধ্যে এক হাজার ৭৩৭ জন সরাসরি ছিনতাইয়ের সাথে সম্পৃক্ত।

ছিনতাইকারীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তেজগাঁও, শাহবাগ, ভাটারা এবং শেরেবাংলানগর থানার আওতাধীন এলাকায়। সবচেয়ে কম ছিনতাইকারীর সংখ্যা মিরপুর, দক্ষিণখান এবং উত্তরা পূর্ব থানায়।

রাতে ছিনতাইয়ের হুমকি: যাত্রীদের টার্গেট

ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাই হয় মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত। বিশেষ করে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, সায়েদাবাদ, মহাখালী এবং গাবতলী বাস টার্মিনালে যাত্রীদের টার্গেট করা হয়। রাতে যাত্রীরা বাস বা ট্রেন থেকে নেমে যখন রিকশা বা সিএনজি নিয়ে গন্তব্যে রওনা হন, তখনই ছিনতাইকারীরা তাদের ওপর হামলা চালায়।

এছাড়া দিনের বেলায় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংকের গ্রাহকদেরও ছিনতাইকারীরা নিশানা বানায়। এসব ছিনতাইকারী অনেক সময় দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে, যা সাধারণ মানুষের জীবনে বিপদের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

পুলিশের টহল কার্যক্রমে ঘাটতি

পুলিশের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের টহল কার্যক্রমে ঘাটতি থাকার কারণে ছিনতাইকারীরা সুযোগ নিচ্ছে। অনেক থানায় পুলিশের উপস্থিতি কম, কারণ যানবাহনের অভাব এবং পুলিশের সংখ্যা সীমিত।

ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ বিভাগের (ক্রাইম ডিভিশন) আটটি শাখায় রাত ৮টা থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধুমাত্র অভিযান বাড়িয়েই এই সমস্যার সমাধান হবে না, বরং পুলিশের মনোবল পুনর্গঠন এবং জনসাধারণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা জরুরি।

ছিনতাইকারী চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সম্প্রতি ধানমন্ডি এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে চাপাতি, লোহার রড এবং একটি পিকআপ ভ্যান উদ্ধার করা হয়, যা ছিনতাই কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়েছিল। ধানমন্ডি, শেরেবাংলা নগর এবং মোহাম্মদপুর এলাকায় এই চক্রটি পিকআপ ভ্যান ব্যবহার করে ছিনতাই করত।

এছাড়া বাড্ডা এলাকায় পেশাদার সশস্ত্র ছিনতাইকারী পারভেজকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তার হেফাজত থেকে ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত একটি সুইচ গিয়ার চাকু এবং ছয়টি মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, পারভেজ দীর্ঘদিন ধরে বাড্ডা এলাকায় ছিনতাই এবং চুরি করে আসছিল।

ছিনতাইকারীদের ধরতে প্রযুক্তির ব্যবহার

ডিএমপি জানিয়েছে, ছিনতাইকারীদের ধরতে ‘সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম’ (এসআইভিএস) এর তথ্য কাজে লাগানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে ছিনতাইকারী এবং ডাকাতদের শনাক্ত করে তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ ও র‍্যাব যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ২০ জনের বেশি ছিনতাইকারী এবং ৩৩ জন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছে।

ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পদক্ষেপ

ঢাকায় ছিনতাই এবং ডাকাতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডিএমপি প্রতিটি থানার ওসিদের সতর্ক করেছে। এছাড়া র‍্যাব সদরদপ্তরও ঢাকায় ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। র‍্যাব ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ মানচিত্র তৈরি করেছে এবং সেই অনুযায়ী টহল কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

ডিএমপি’র উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, “ছিনতাই প্রতিরোধে আমাদের টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। চিহ্নিত ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। পেশাদার ছিনতাইকারী অনেকে আটক হয়েছে।”

র‌্যাবের অভিযানের অগ্রগতি

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিম ফেরদৌস বলেছেন, “আমরা ছিনতাই প্রবণ এলাকা শনাক্ত করছি এবং সে অনুযায়ী টহল টিম মোতায়েন করছি। এছাড়া স্থানীয়দের তথ্য সংগ্রহ করে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করছি।”

তিনি আরও বলেন, “আমাদের ব্যাটালিয়নগুলো ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ মানচিত্র তৈরি করেছে। সে অনুযায়ী আমরা ছিনতাইকারী ধরার অভিযান চালাচ্ছি এবং জনজীবনে স্বস্তি আনার চেষ্টা করছি।”

আরও পড়তে পারেন