,

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ নিয়ে বিতর্ক: সংবিধান কি কোনও সমাধান দিতে পারবে?

শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মন্তব্যের পর নতুন করে উত্তপ্ত রাজনৈতিক অঙ্গন

বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সাম্প্রতিক মন্তব্য, যেখানে তিনি বলেছেন যে তার হাতে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রের কোনও দালিলিক প্রমাণ নেই, তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীরা রাষ্ট্রপতির সমালোচনা করেছেন এবং অনেকে তার পদত্যাগ দাবি করছেন। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, রাষ্ট্রপতিকে কি আইন বা সংবিধান অনুযায়ী সরানো সম্ভব?

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, আইন ও সংবিধানের বাধা সত্ত্বেও জনআকাঙ্ক্ষার আলোকে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে অন্য কাউকে স্থলাভিষিক্ত করা অসম্ভব নয়। যদিও সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়নি, তারপরও অনেকেই মনে করছেন, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংবিধান বড় কোনও বাধা হবে না।

‘মীমাংসিত বিষয়ে নতুন করে বিতর্ক না করার’ আহ্বান রাষ্ট্রপতির

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বক্তব্য প্রকাশের পর ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে মিছিল ও সমাবেশ করে ছাত্রনেতারা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করেন।

সোমবার বঙ্গভবন থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘মীমাংসিত বিষয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি না করার জন্য’ তিনি সকলকে আহ্বান জানিয়েছেন। তবে এই বিবৃতির পরও বিতর্ক থামেনি।

সামাজিক মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বিরোধীরা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা তাকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জোরালোভাবে তুলেছেন। এ ছাড়া আইনি বিশেষজ্ঞরাও সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রপতিকে সরানোর প্রশ্নে ভিন্ন মত পোষণ করছেন।

রাষ্ট্রপতিকে সরানোর আইনি জটিলতা

সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক মনে করেন, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে সরানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, “সংসদ রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করতে পারে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর সংসদ বাতিল করা হয়েছে, ফলে সেই সুযোগ আর নেই। আবার, রাষ্ট্রপতি চাইলে স্পিকারের কাছে পদত্যাগ করতে পারেন, কিন্তু স্পিকার পদত্যাগ করেছেন এবং ডেপুটি স্পিকার কারাগারে থাকায় সেটিও সম্ভব হচ্ছে না।”

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন, গণঅভ্যুত্থানের পর সবকিছু বাতিল না করে কোনটি বাদ দেওয়া হয়েছে আর কোনটি রাখা হয়েছে, তার ফলে একটি আইনি নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। “সংবিধান স্থগিত করা হয়নি, কিন্তু পুরোপুরি অনুসরণও করা হচ্ছে না। এতে লিগ্যাল অ্যানার্কির সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে অনেক কিছুই সংবিধান অনুসারে হচ্ছে না,” বলছিলেন তিনি।

অতীতে রাষ্ট্রপতিদের অপসারণের নজির

বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্রপতি পদে অস্বাভাবিকভাবে আসা বা পদত্যাগ করার বেশ কয়েকটি নজির রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। এর কয়েক মাস পর তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম। ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর প্রবল গণআন্দোলনের মুখে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন।

এই অতীতের ঘটনা উল্লেখ করে অনেকে মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতেও রাষ্ট্রপতিকে সরানোর পথ খোলা রয়েছে। বিশেষ করে যখন দেশ একটি অস্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন আইন এবং সংবিধানের বাধাগুলি নির্দিষ্টভাবে কার্যকর নাও হতে পারে।

‘আইন অনুযায়ী অসম্ভব, তবে জনআকাঙ্ক্ষার পথে সম্ভব’

আইনজীবী শাহদীন মালিক বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি মনে করেন, জনআকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতিকে সরানো সম্ভব হতে পারে। “স্বৈরাচারী সরকারের বিদায়ের পর সবকিছু তো সংবিধান অনুযায়ী হচ্ছে না। তাই নিয়ম বা সংবিধানের প্রশ্ন অবান্তর। বরং জনআকাঙ্ক্ষার আলোকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা সরকার চাইলে করতেই পারে,” বলছিলেন মি. মালিক।

তার মতে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অনেকেই পদত্যাগ করেছেন। এটি ইঙ্গিত করে যে রাষ্ট্রপতিকে সরানোর ক্ষেত্রেও এ ধরনের কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান

রাষ্ট্রপতির বিতর্কিত মন্তব্যের পর বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতির সমালোচনা করলেও সরাসরি তার পদত্যাগ দাবি করেনি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেছেন, তিনি শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করছেন। তবে দলটির হাইকমান্ড থেকে সিনিয়র নেতাদের এ বিষয়ে বিচ্ছিন্ন মন্তব্য না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলছেন, রাষ্ট্রপতির সাম্প্রতিক বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন, যা শপথ ভঙ্গের শামিল। তবে তারা সরাসরি তার পদত্যাগের দাবি তুলেনি।

আন্দোলনের ভবিষ্যৎ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি তুললেও রাজনৈতিক দলগুলো এখনো বিষয়টি নিয়ে পুরোপুরি সিদ্ধান্তে আসেনি। বিশেষ করে বিএনপি দেখছে, রাষ্ট্রপতি আসলেই কতটা সিরিয়াস ছিলেন তার মন্তব্য নিয়ে। দলটি রাষ্ট্রপতির মন্তব্যের পেছনে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল কি না তা নিয়েও অনুসন্ধান করছে।

এদিকে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রপতিকে সরানো হলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন, অভ্যুত্থানের পর পরই সবকিছু বাতিল করা হলে এই সংকট তৈরি হতো না। তবে এখন রাষ্ট্রপতিকে সরানো হলে ভবিষ্যতে আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে।

ভবিষ্যৎ কী?

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত অনিশ্চিত। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে সরানো কঠিন হলেও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা অসম্ভব নয় বলে অনেকে মনে করছেন। সংবিধানের বাইরের কোনো প্রক্রিয়া অবলম্বন করে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে, তবে তা করতে গেলে সরকারকে জনমত এবং আইনি বাধাগুলিকে সামলাতে হবে।

এখন দেখার বিষয়, রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে এবং জনআকাঙ্ক্ষার দাবিকে কতটা গুরুত্ব দেবে।

আরও পড়তে পারেন