, ,

ভারতীয় আতিথেয়তায় আড়াই মাস: কোথায় আছেন শেখ হাসিনা?

বাংলাদেশ থেকে দিল্লি পর্যন্ত যাত্রার পরও তার অবস্থান রহস্যে ঘেরা

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আড়াই মাস আগে হঠাৎ করেই ভারতীয় সামরিক বিমানে চেপে দিল্লিতে পা রাখেন। এরপর থেকে তিনি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। কোনো সংবাদ সম্মেলন, প্রকাশ্য উপস্থিতি, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও তার কোনো ছবি বা ভিডিও দেখা যায়নি। মাঝে মাঝে কথিত ফোনালাপের অডিও প্রকাশিত হলেও সেগুলো তার কণ্ঠস্বর কিনা তা নিশ্চিত নয়। ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও তার অবস্থান নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করা হয়নি।

১৭ অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল নিশ্চিত করেছেন যে, শেখ হাসিনা এখনও ভারতে রয়েছেন। তবে তিনি কোথায় এবং কিভাবে আছেন, সেটি নিশ্চিত করা হয়নি। ভারত তাকে আপাতত ‘গেস্ট’ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে, তবে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার পরিকল্পনা এখনও পর্যন্ত নেই। ফলে এ নিয়ে গুঞ্জন আরও বাড়ছে এবং রহস্যের মেঘ ঘনিভূত হচ্ছে।

গাজিয়াবাদ থেকে অজ্ঞাত স্থানে: কোথায় আছেন শেখ হাসিনা?

৫ই আগস্ট সন্ধ্যায় দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে নামেন শেখ হাসিনা। সেখানে কয়েক দিন থাকার পর, তাকে সরিয়ে নেওয়া হয়। হিন্ডন একটি সামরিক ঘাঁটি যেখানে দীর্ঘমেয়াদি ভিভিআইপি আতিথেয়তার ব্যবস্থা নেই। সামরিক ঘাঁটিতে থাকা কেবল অস্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে, তাই সেখান থেকে তাকে দ্রুত অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়েছে।

এরপর থেকে তার পরবর্তী অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন গুঞ্জন রটছে। কেউ কেউ বলছেন, তিনি দিল্লিতে তার মেয়ে সাইমা ওয়াজেদের বাসভবনে থাকতে পারেন। আবার অন্যদের মতে, তিনি উত্তরপ্রদেশের মীরাট বা হরিয়ানার মানেসরে আধাসামরিক বাহিনীর কোনো সেফ হাউসে রয়েছেন। দিল্লির মতো বড় শহরের নাগরিক পরিবেশে তিনি থাকতে পারেন এমন ধারণা কল্পনাতীত। কিন্তু যেখানে থাকুন না কেন, তাকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয়েছে।

রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে কূটনৈতিক দ্বিধা: ভারত কি সিদ্ধান্ত নেবে?

শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে ভারত স্পর্শকাতর অবস্থানে রয়েছে। ভারতের জন্য শেখ হাসিনাকে আতিথেয়তা দেওয়া সহজ, তবে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি একটি জটিল সমস্যা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কিন্তু সেবারও তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম দেওয়া হয়নি।

ভারত এখনও পর্যন্ত তাকে কোনো ধরনের রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়নি বা তার কোনো আশ্রয় প্রার্থনা করার আবেদন আসেনি। কিন্তু যদি ভবিষ্যতে এমন প্রস্তাব আসে, ভারতকে কূটনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেশটির অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক বিবেচনার ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতাও রয়েছে।

নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তার মধ্যে: ‘সেফ হাউস’ এ শেখ হাসিনা

যে আড়াই মাসের সময় ধরে শেখ হাসিনাকে কোথাও দেখা যায়নি, সেটা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। মূল উদ্দেশ্য ছিল তার অবস্থান নিয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখা এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে এর ফলে তার কোনো আত্মীয়-স্বজন, এমনকি দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের পথও সীমিত হয়ে গেছে। যদিও তিনি তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে টেলিফোনে এবং ভিডিও কলে মাঝে মাঝে যোগাযোগ করেছেন।

শেখ হাসিনার নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। এই নিরাপত্তার মধ্যে শারীরিক নিরাপত্তা ছাড়াও, তার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে যে, ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড (এনএসজি) তার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। এমনকি শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তার সঙ্গে নিয়মিত ডিব্রিফিং সেশনও করছেন। এসব সেশনে তার নিরাপত্তা এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়।

ভারতের জন্য কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ: আশ্রয় নাকি প্রত্যর্পণ?

ভারতীয় সরকার শেখ হাসিনাকে আপাতত গেস্ট হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেও, এ নিয়ে বহু জটিলতা রয়েছে। যদি তাকে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত হতে পারে। ঢাকার পক্ষ থেকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা থাকলে, সেটি ভারতের জন্য প্রত্যর্পণের চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে, তবে ভারত এই চুক্তির অধীনে শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বরং তাকে রাখার পক্ষে কৌশলগত সুবিধা খুঁজছে। কারণ, শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া ভারতের কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়েও আলোচনা হতে পারে।

বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং শেখ হাসিনার ভূমিকা

বাংলাদেশে রাজনীতিতে শেখ হাসিনার প্রভাব বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দেশের দীর্ঘস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে, শেখ হাসিনার ভারতীয় আতিথেয়তা অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।

বাংলাদেশে আন্দোলনরত বিরোধী দলের দাবির মধ্যে রয়েছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, যার মধ্যে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া অন্তর্ভুক্ত। এই পরিস্থিতিতে, শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশল এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পথ নিয়ে নানা ধরনের কূটনৈতিক হিসাব-নিকাশ তৈরি করেছে।

শেখ হাসিনার ভারতীয় আতিথেয়তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

শেখ হাসিনা এর আগেও ভারতীয় আতিথেয়তা পেয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর, তিনি এবং তার বোন শেখ রেহানা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন তিনি ছদ্মপরিচয়ে থাকতেন এবং ভারতের সরকারের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ও আতিথেয়তা পেয়েছিলেন। সেই সময়ে তিনি ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সেই সম্পর্কই হয়তো তাকে আবারও ভারতীয় মাটিতে ফিরিয়ে এনেছে।

তবে এবারকার পরিস্থিতি ভিন্ন। আগেরবার তিনি ছিলেন একজন রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী; এবার তিনি একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতীয় আতিথেয়তায় রয়েছেন। এই আতিথেয়তার পেছনে ভারতের রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক কৌশলের পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে, যা তাকে রাখার সিদ্ধান্তকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

ভারতীয় রাজনীতিতে শেখ হাসিনার অবস্থানের প্রভাব

ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও কিছু প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষত, বিজেপি এবং কংগ্রেসের মতো প্রধান দলগুলোর মধ্যে শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন মতবিরোধ রয়েছে। কিছু রাজনীতিবিদ মনে করেন, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক আশ্রয় ভারতের জন্য কৌশলগত সুবিধা বয়ে আনতে পারে। আবার অন্যদলের দাবি, তাকে আশ্রয় দিলে বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

এছাড়াও, বাংলাদেশের রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ অবস্থার ওপর ভারতের কোনো পদক্ষেপের প্রভাব কতটুকু পড়বে, সেটি নিয়ে সমীক্ষা চলছে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা ভারতের শরণাপন্ন হয়েছেন বলেই ধারণা করা হয়। তাই ভারতের সরকারও তাকে রাখার কৌশল নিয়ে আরো মনোযোগী হতে পারে।

শেখ হাসিনার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে?

শেখ হাসিনার ভারতীয় আতিথেয়তা নিয়ে এখন যে প্রশ্ন উঠছে তা হলো, তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে? তিনি কি আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারেন, নাকি ভারতে দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান করবেন? তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই, তবে বিভিন্ন কূটনৈতিক সূত্র মতে, তিনি এক ধরনের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের অপেক্ষায় রয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের কৌশলগত পদক্ষেপ হতে পারে শেখ হাসিনাকে পুনরায় রাজনৈতিক ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত করা। এর মধ্যে তার দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করা হতে পারে। এছাড়াও, শেখ হাসিনার সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ রাজনীতি এবং কৌশল নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরির জন্য ভারত তাকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতে পারে।

শেখ হাসিনার অবস্থান এখন অনিশ্চিত হলেও, তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যে বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, তা বলাই বাহুল্য। ভারত তাকে কিভাবে সামলাবে এবং শেখ হাসিনা নিজে কিভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবেন, সেটি ঠিক করবে দুই দেশের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

আরও পড়তে পারেন