সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত ছয় মাসের মধ্যে শেষ করতে টাস্কফোর্সকে হাইকোর্টের নির্দেশ

২০১২ সালের বিতর্কিত সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে অবশেষে অগ্রগতি আশা

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার তদন্ত আগামী ছয় মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার জন্য উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন টাস্কফোর্স কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। আজ বুধবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ এই পূর্ণাঙ্গ আদেশ দেন।

এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে র‍্যাবের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাদের সরিয়ে দিয়ে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল। বিভিন্ন সংস্থার অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত এই টাস্কফোর্সকে মামলার তদন্ত কাজ সম্পন্ন করে ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয় এবং আজকের আদেশে সেই ছয় মাসের সময়সীমার গণনা শুরু হয়।

১১ বছরেও সমাধান হয়নি সাগর-রুনি হত্যা মামলা

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের একটি ভাড়া বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার এবং মেহেরুন রুনি। সাগর তখন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেন এবং রুনি ছিলেন এটিএন বাংলার বিশেষ প্রতিবেদক। তাদের এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে দেশের সাংবাদিক সমাজসহ সবার মাঝে চরম শোক ও ক্ষোভের জন্ম দেয়।

হত্যার দিনই মেহেরুন রুনির ভাই নওশের রোমান তেজগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। প্রথমে পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও কয়েকদিনের মধ্যেই তদন্তভার গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়।

র‍্যাবের তদন্ত ও বারবার প্রতিবেদন পেছানোর অভিযোগ

২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্ট এই মামলা তদন্তের জন্য র‍্যাবকে দায়িত্ব দেয়। তবে তদন্ত শুরু থেকেই নানা জটিলতা ও বিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। এ পর্যন্ত মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ ১১১ বার পিছিয়েছে।

এই দীর্ঘ সময় ধরে মামলার কোনো সুরাহা না হওয়ায়, তদন্তে র‍্যাবের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেছেন, “র‍্যাবের ব্যর্থতার কারণেই এই মামলায় এতবার তদন্ত প্রতিবেদনের তারিখ পিছিয়েছে, যা ভুক্তভোগী পরিবার ও সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের হতাশা সৃষ্টি করেছে।”

টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ ও তদন্তের নতুন ধারা

গত ৩০ সেপ্টেম্বর, হাইকোর্ট মামলার ধীরগতিতে অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে র‍্যাবের তদন্ত কার্যক্রম সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়, বিভিন্ন সংস্থার অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠিত হবে এবং এ টাস্কফোর্সকে আগামী ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।

আদালত বলেছেন, এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপর ন্যস্ত থাকবে এবং প্রয়োজনীয় সকল সহায়তা প্রদান করতে হবে। মামলার বাদীপক্ষ আশা করছেন যে, টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে মামলার অগ্রগতিতে একটি নতুন ধারা সূচিত হবে।

সাংবাদিক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতিফলন

সাগর-রুনি হত্যা মামলা নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষোভ এবং উদ্বেগ ছিল। প্রতি বছর ১১ ফেব্রুয়ারি, সাংবাদিক সমাজ হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে আসছে। এই মামলায় তদন্তের ধীরগতি ও প্রতিবেদন পেছানোর কারণে বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা হারাচ্ছেন অনেকে।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করার দাবি জানিয়ে আসছে।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড: প্রশ্নগুলো থেকে গেলো

এই হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠেছে, যেগুলোর উত্তর আজও অজানা। হত্যার প্রকৃত কারণ, হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য, এবং হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রায় এক দশক পার হয়ে গেছে।

নানা সময়ে সাগর ও রুনির বন্ধু-বান্ধব এবং সহকর্মীদের মধ্যে সন্দেহের তীর নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এমনকি তদন্তকারীরা পরিবারের সদস্যদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য প্রকাশ পায়নি, যা এই হত্যাকাণ্ডের সমাধানে সহায়ক হতে পারে।

আদালতের পরবর্তী নির্দেশনা ও ভবিষ্যতের আশাবাদ

হাইকোর্টের আজকের আদেশ অনুসারে ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত কাজ সম্পন্ন করতে হবে এবং এই সময়সীমার মধ্যেই রিপোর্ট জমা দিতে হবে। আদালত পরবর্তী নির্দেশনার জন্য আগামী বছরের এপ্রিল মাসে মামলাটি শুনানির জন্য পুনরায় তলব করেছে।

এই নির্দেশনায় সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রাপ্তির আশা পুনরুজ্জীবিত করেছে, তবে তদন্তের গতিপ্রকৃতি এবং টাস্কফোর্সের কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করার উপরই নির্ভর করছে এই মামলার ভবিষ্যত।

ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা

সাগর-রুনির পরিবার এবং সমগ্র সাংবাদিক সমাজ এখন ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় আছে। যদিও এই অপেক্ষার পরিসমাপ্তি কখন ঘটবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না, তবে হাইকোর্টের সর্বশেষ আদেশটি নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে।

টাস্কফোর্স যদি তাদের কাজ দ্রুত এবং সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারে, তবে এই দীর্ঘ ১১ বছরের প্রতীক্ষা একটি সমাধানের দিকে যেতে পারে।

আরও পড়তে পারেন