ভারত-বাংলাদেশের প্রত্যর্পণ চুক্তি এবং শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার সম্ভাবনা নিয়ে বিতর্ক
ভারতে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার সম্ভাবনা নিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে ভারতের আশ্রয়ে রয়েছেন তিনি, এবং সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ভারত তাকে একটি ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ প্রদান করেছে, যা তাকে বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি দেয়। এই ডকুমেন্টের কারণে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে কি না, তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা রয়েছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি জানিয়েছেন, ট্রাভেল ডকুমেন্ট দেয়া হলে তা আটকানোর কোনো উপায় নেই। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম মনে করেন, যেহেতু ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে, তাই এই চুক্তি অনুযায়ী আইনিভাবে শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হতে পারে। তবে কূটনীতিকরা মনে করছেন, শুধুমাত্র আইনি প্রক্রিয়া নয়, রাজনৈতিক বাধা-বিপত্তিও এখানে বড় ভূমিকা রাখবে।
ভারত-বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির শর্ত এবং জটিলতা
ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি প্রথমে ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত হয় এবং ২০১৬ সালে এই চুক্তি সংশোধন করা হয়। সংশোধিত চুক্তিতে বন্দি হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে, তবে কিছু শর্ত এখনও রয়ে গেছে, যা এই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলতে পারে। চুক্তি অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হন, যেমন- হত্যা, নরহত্যা, সন্ত্রাসবাদ বা গুরুতর আর্থিক অপরাধ, তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেয়ার সুযোগ রয়েছে।
তবে, চুক্তির একটি বিশেষ ধারা রয়েছে যা প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অপরাধের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। যদি কোনো অপরাধ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হয়, তাহলে প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ রয়েছে। তবে এমন কিছু অপরাধ রয়েছে যা রাজনৈতিক বলার সুযোগ নেই, যেমন- হত্যা বা সন্ত্রাসবাদ।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, “চুক্তি অনুযায়ী আইনগতভাবে যেকোনো ব্যক্তিকে ফেরত আনা সম্ভব, যদি তার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয় এবং আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু এখানে ভারতের রাজনৈতিক বিবেচনার বিষয়টিও গুরুত্ব বহন করবে।”
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়া
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই তাকে ভারতে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে। এর পর থেকে তার বিরুদ্ধে দুই শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, আর্থিক দুর্নীতি এবং অন্যান্য গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও এখনও তার বিরুদ্ধে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়নি, যা তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াকে আরও দীর্ঘায়িত করছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছেন, “ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর বিচারক নিয়োগ দেয়া হলে আদালতের কার্যক্রম শুরু হবে। তখনই আমরা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করবো এবং সেই মুহূর্তেই ইন্টারপোলের সহযোগিতাসহ কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালিয়ে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেবো।”
সংশ্লিষ্টদের মতে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পরও তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সরাসরি সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ ভারত সরকারকে একটি কঠিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ট্রাভেল ডকুমেন্টের ভূমিকা এবং এর প্রভাব
সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার ট্রাভেল ডকুমেন্ট সম্পর্কে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এটি মূলত ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারি করা একটি ‘আইডেন্টিটি সার্টিফিকেট’, যা সাধারণত বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যারা পাসপোর্ট ছাড়াই ভ্রমণ করতে চান বা পাসপোর্ট নেই, তাদের জন্য এই বিশেষ ধরনের ডকুমেন্ট ইস্যু করা হয়।
শেখ হাসিনার পাসপোর্ট ইতিমধ্যেই বাতিল করা হয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্বারা। তার মানে, তিনি বর্তমানে কোনো বৈধ পাসপোর্ট ছাড়াই রয়েছেন এবং ট্রাভেল ডকুমেন্ট তার বিদেশ ভ্রমণের একমাত্র উপায় হিসেবে রয়ে গেছে। এ অবস্থায়, তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তর্জাতিক আইন এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ট্রাভেল ডকুমেন্টের মাধ্যমে অন্য দেশে গেলে তার ফেরত আসার প্রক্রিয়া আরও জটিল হতে পারে। কারণ তখন সেই দেশের সাথে বাংলাদেশের প্রত্যর্পণ চুক্তির উপর নির্ভর করতে হবে।
ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রভাব
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়ার আগে ভারতের রাজনৈতিক বিবেচনা এবং সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। শেখ হাসিনার সাথে ভারতের বর্তমান সরকারের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে মজবুত বলে ধারণা করা হয়। কূটনীতিকরা মনে করেন, ভারত সরকার শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়ে যদি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক অনুরোধ আসে, তবে তারা বিষয়টি গভীর রাজনৈতিক বিবেচনায় নেবে।
অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলেন, “ভারতের সাথে বাংলাদেশের প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকা সত্ত্বেও যদি দেখা যায় শেখ হাসিনার জীবনের জন্য বিপদের আশঙ্কা আছে, তাহলে ভারত তাকে ফেরত দেয়ার আগে অনেক বিবেচনা করবে।”
এম হুমায়ুন কবিরের মতে, “শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ প্রশ্নে ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আইনগত প্রক্রিয়া শুরু হলেও, ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণেই প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।”
আদালত এবং আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা
শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনাল এবং আদালতের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। আদালত যদি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে, তাহলে তা ভারতের কাছে পাঠানোর পর এক ধাপ এগিয়ে যাবে এই প্রক্রিয়া। তবে, এ ক্ষেত্রে ইন্টারপোলের সহযোগিতা প্রয়োজন হতে পারে। ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিস’ জারি হলে, বিভিন্ন দেশ তাদের বিচার প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক করতে পারে।
কিন্তু, এই ‘রেড নোটিস’ জারি করা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণ এবং কূটনৈতিক অবস্থার জন্য প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত হতে পারে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনার ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন নানা জল্পনা চলছে। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিচারবিভাগ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবস্থার উপর নির্ভর করছে কবে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন না হলে, এই প্রক্রিয়া আরও বিলম্বিত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম ইতিমধ্যে জানিয়েছেন, “কোর্ট বসলে প্রথম দিনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা চাওয়া হবে। তখন থেকেই আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে।”
শেখ হাসিনার রাজনৈতিক আশ্রয় এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড
ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার প্রশ্ন নিয়ে দেশটিতে আলোচনা চলছে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভারতে তার রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য প্রকাশ না হলেও, তার অবস্থান একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে ধরা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ভারত সরকার তাকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের মর্যাদা দেয়, তবে তাকে ফেরত আনার প্রক্রিয়া আরও কঠিন হতে পারে।