আবরার হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তাল বুয়েট এবং ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনা পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশের শিক্ষা ও রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল।
এই হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং পুরো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উত্তাল হয়ে ওঠে। এর জের ধরে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় তখন আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের ভূমিকা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। দেশজুড়ে এর বিরোধিতা ও প্রতিবাদ সংগঠিত হয়।
এটি তখন শিরোনামে আসে বিবিসি, আল জাজিরা, গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
আবরারের মৃত্যু রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতি ও ভারত-বিরোধী সেন্টিমেন্ট নিয়ে।
ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবির প্রেক্ষাপট
আবরার হত্যাকাণ্ডের পরপরই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি উঠতে থাকে।
বুয়েটের শিক্ষার্থীরা তীব্র আন্দোলন শুরু করে, যেখানে তারা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানায়। সেই দাবি মেনে নিয়ে বুয়েট কর্তৃপক্ষ তখন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে।
এদিকে, বাংলাদেশে বহুদিন ধরে ছাত্ররাজনীতি চালু থাকলেও আবরার হত্যাকাণ্ডের পর বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। বিশেষত, ছাত্রলীগের দ্বারা আবরারের হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক রোবায়েত ফেরদৌস মনে করেন, আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড ছিল “জাতির ইতিহাসের একটি মোড় ঘোরানো ঘটনা।” তিনি বলেন, “এই ঘটনার কারণে ক্ষমতাসীনদের প্রতি তীব্র ক্ষোভের পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতির প্রতি চরম বিতৃষ্ণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো।”
আবরার হত্যাকাণ্ডের বিচার ও ক্ষতিপূরণ
আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় তৎক্ষণাৎ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়।
২০২১ সালে একটি ঢাকার আদালত এ মামলার রায়ে ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষণা করে। তবে এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হয়েছে, যা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।
অন্যদিকে, হাইকোর্ট আবরারের পরিবারকে দশ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেছে।
হত্যাকাণ্ডের দিন যা ঘটেছিল
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরে বাংলা হলে আবরার ফাহাদকে ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী।
এর আগে আবরার তার ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে ভারত-বিরোধী একটি পোস্ট করেন। সেটি ছিল তার হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কারণ।
তবে পরবর্তীতে জানা যায়, তাকে শিবির আখ্যা দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। সেই রাতেই তার মৃতদেহ হলের সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় ফেলে রাখা হয়।
আবরারকে পিটিয়ে হত্যার পর দ্রুতই পুলিশের তদন্তের মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ বেরিয়ে আসে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, “অভিযুক্তরা আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার মধ্য দিয়ে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছিল।”
ভারত-বিরোধিতার প্রতীক হয়ে ওঠেন আবরার
আবরার ফাহাদের ফেসবুক পোস্টে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধিতা করার বিষয়টি তখনই আলোচিত হতে থাকে।
তার ফেসবুক পোস্টে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সমালোচনা এবং বাংলাদেশের সম্পদ ভারতের ব্যবহারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। বিশেষ করে পানি ও গ্যাস সরবরাহ ইস্যুতে তার মন্তব্য ভারত-বিরোধী ছিল।
আবরারের এই পোস্টই পরবর্তীতে তাকে ভারত-বিরোধী আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন তাকে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধিতাকারী হিসেবে তুলে ধরে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আবরার হত্যাকাণ্ড
আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতেও ব্যাপক গুরুত্ব পায়।
বিবিসি, আল জাজিরা, গার্ডিয়ান, ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ড এবং তার পরবর্তী বিক্ষোভের খবর নিয়মিত প্রকাশিত হয়।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো, আবরারকে চার ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
আবার, আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো যে এই হত্যাকাণ্ডের পর দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র বিক্ষোভ তীব্র হয়ে উঠেছিলো।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে আবরারের ফেসবুক পোস্টের উল্লেখ করে বলা হয়েছিলো, “ভারত-বাংলাদেশের পানি চুক্তির সমালোচনা করে আবরারকে হত্যা করা হয়।”
ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক
আবরারের হত্যার পর থেকে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবির বিষয়টি নিয়ে দেশে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
বুয়েটের শিক্ষার্থীরা প্রথমে আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি আদায় করে নেয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি তীব্র হতে থাকে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আবরারের হত্যাকাণ্ডের ফলে ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় থাকা ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক আস্থা সংকট তৈরি হয়।
সরকার ও ছাত্রলীগের প্রতিক্রিয়া
আবরার হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা এই ঘটনার নিন্দা জানান।
তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান জয় বলেছিলেন, “ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এ ধরনের কার্যক্রম কোনোভাবে সমর্থন করা হবে না। ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য অতি উৎসাহী কিছু নেতা-কর্মী এ ধরনের কাজ করেছে।”
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আবরার হত্যাকাণ্ড ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের ছাত্র সংগঠনের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।
আবরার হত্যাকাণ্ডের প্রভাব ও ভবিষ্যৎ
আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন ও রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়, বরং এটি দেশের ছাত্ররাজনীতি এবং ভারত-বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘোরানো ঘটনা।
আবরার হত্যার পর থেকে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তবে দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও একই ধরনের দাবি উঠছে।
এই ঘটনার পর থেকে ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা, নিয়ে জনমনে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে।
আবরার ফাহাদ এখন ‘ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী’ প্রতীকে পরিণত হয়েছেন, যা তাকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিশেষ অবস্থানে নিয়ে গেছে।