হিযবুত তাহ্‌রীর
,

বাংলাদেশের রাস্তায় কালেমা খচিত কালো পতাকা নিয়ে মিছিল: জঙ্গিগোষ্ঠীর ইন্ধন নাকি রাজনৈতিক চাল?

সাম্প্রতিককালে রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কালেমা খচিত কালো পতাকা হাতে মিছিলের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। এসব মিছিল থেকে ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ, ইসলামের নবীকে কটূক্তির প্রতিবাদ, এবং ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিও তোলা হয়েছে। তবে এ ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে চলছে নানা মতামত ও বিতর্ক।

বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে দাবি করছেন, এই কালো পতাকা ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতীক, এবং এই মিছিলের লক্ষ্য হলো দেশে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। অন্যদিকে, কিছু মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করে বলছেন, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এমনকি এসব মিছিলকারীদের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।

ঢাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, এসব মিছিলের সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহ্‌রীরের সদস্যরা জড়িত।

পুলিশের বক্তব্য

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মাইনুল হাসান জানিয়েছেন, হিযবুত তাহ্‌রীরের মতো নিষিদ্ধ সংগঠনগুলো প্রকাশ্যে মাঠে নামতে পারছে না। তবে তারা এখন অতর্কিতভাবে নামার চেষ্টা করছে। তিনি বলেছেন, এ ধরনের মিছিলের বিরুদ্ধে পুলিশ ইতোমধ্যে অভিযান শুরু করেছে।

সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে একটি মিছিল বের করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সেই মিছিল থেকে পুলিশ তিনজনকে আটক করেছে। এছাড়াও রোববার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করতে দেখা গেছে।

স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ

ঢাকার জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে রোববার একটি মিছিল বের করে সেন্ট জোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা। ওই মিছিলে তাদের হাতে ছিল বাংলাদেশের পতাকা, ফিলিস্তিনের পতাকা এবং কালেমা লেখা কালো পতাকা।

মিছিলকারীদের ব্যানারে লেখা ছিল, “ইসলামের নবীকে কটূক্তির প্রতিবাদ ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জবাবে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল।” তারা স্লোগান দিচ্ছিল, “মুক্তির এক পথ, খিলাফত-খিলাফত”, “তুমি কে আমি কে, মুসলমান-মুসলমান”।

সাংবাদিক ফয়সাল আলম এই মিছিলের একটি ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন। তিনি বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের কিছু শিক্ষকেরও উপস্থিতি ছিল। মিছিলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে স্লোগান।

একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়ও একদল শিক্ষার্থীকে কালেমা খচিত কালো ও সাদা পতাকা নিয়ে মিছিল করতে দেখা গেছে।

মিছিল ও পতাকার বৈশিষ্ট্য

সম্প্রতি ঢাকার নামি-দামি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আলাদা আলাদা মিছিল করতে দেখা গেছে। তাদের হাতে ছিল বিশাল কালেমা লেখা কালো পতাকা। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কিশোরগঞ্জের একটি মিছিল থেকে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদ জানানো হয় এবং ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে স্লোগান তোলা হয়। ওই মিছিলে কালো পতাকার বাইরেও অন্য একটি পতাকা দেখা গেছে, যা আইএস বা ইসলামিক স্টেটের পতাকার সঙ্গে মিল রয়েছে বলে ফ্যাক্ট চেকার কদরুদ্দিন শিশির জানিয়েছেন।

পতাকা ও এর অর্থ

ঢাকার মিছিলগুলোতে কালেমা খচিত কালো পতাকা নিয়ে অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। তবে পুলিশ এখনো শনাক্ত করতে পারেনি কারা এই পতাকা ব্যবহার করছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইসলামের নবীর যুগে নির্দিষ্ট কোনো পতাকা ইসলামের প্রতীক ছিল না। তবে পরবর্তী সময়ে কিছু ক্ষেত্রে কালেমা খচিত কালো পতাকা ব্যবহার হতে দেখা গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শাফি মো. মোস্তফা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে আইএস গোষ্ঠী এই ধরনের পতাকা ব্যবহার করছে। ফলে বাংলাদেশে এই পতাকা ব্যবহার করলে এক ধরনের ট্যাগিংয়ের সম্ভাবনা থাকবেই।

কিছু গবেষক মনে করছেন, এই পতাকার সঙ্গে ধর্মীয় কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এটি একটি রাজনৈতিক ও জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

পুলিশি তদন্ত ও তৎপরতা

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. মাসুদ করিম জানিয়েছেন, এই মিছিলগুলো নিয়ে ক্লোজ মনিটরিং করা হচ্ছে এবং এর পেছনে কারা জড়িত তা তদন্ত করা হচ্ছে।

পুলিশের দাবি, এসব মিছিলে হিযবুত তাহ্‌রীরের সদস্যরা জড়িত। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যের ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে এবং ভারতে ইসলাম ধর্মকে কটূক্তির প্রতিবাদ জানিয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদে ইসলামী আন্দোলনের মিছিল থেকে কালো পতাকা নিয়ে তিনজনকে আটক করা হয়েছে। একই দিন পুলিশের অভিযান চলাকালে হিযবুত তাহ্‌রীরের মিডিয়া সমন্বয়ক ইমতিয়াজ সেলিমকে আটক করা হয়।

ডিএমপি কমিশনার মাইনুল হাসান বলেন, হিযবুত তাহ্‌রীর এতদিন আড়ালে ছিল। এখন তারা মাঠে আসার চেষ্টা করছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের প্রতিহত করতে প্রস্তুত। তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষকেও এই ধরনের সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

শিক্ষার্থীদের মিছিলের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য?

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মিছিল শুধু হিযবুত তাহ্‌রীরের উদ্যোগ নয়। এখানে আরও কিছু সালাফি গ্রুপ জড়িত থাকতে পারে, যারা খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলছে।

গবেষক শাফি মো. মোস্তফা মনে করেন, স্কুলের শিক্ষার্থীদের হাতে পতাকা দিয়ে মিছিল করানো একটি সুসংগঠিত পরিকল্পনার অংশ। বিষয়টি সহজভাবে নেওয়া ঠিক হবে না। গোয়েন্দারা বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্তা মো. করিম বলেন, আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এ ধরনের আরও অনেকে রয়েছে যাদের ওপর নজরদারি রাখা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্ক ও পুলিশের পরামর্শ

কালেমা খচিত কালো পতাকা নিয়ে মিছিল এবং এর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জঙ্গি তৎপরতা ও উগ্রপন্থী ধারণার প্রচার হচ্ছে।

পুলিশ সাধারণ জনগণকে এ ধরনের মিছিল ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছে।

আরও পড়তে পারেন