সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে মব জাস্টিসের নামে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। মানুষের বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা এবং সামাজিক অস্থিরতা এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে দেখা দিলেও, এ জাতীয় আচরণ দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে।
সর্বশেষ ঘটনা ঘটে খাগড়াছড়িতে, যেখানে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে এক শিক্ষককে বিদ্যালয়ের ভেতরেই পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, পুলিশও কখনো কখনো এসব মব জাস্টিসের শিকার হচ্ছে।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে দেশে অন্তত ২৫ জনকে মব জাস্টিসের নামে হত্যা করা হয়েছে। নির্যাতন, মারধর, লাঞ্ছনা এবং অপমানের ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিদিনই। দেশের বিভিন্ন জায়গায় গণপিটুনির ঘটনা সমাজে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।
অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার বারবার হুঁশিয়ারি দিলেও আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া বন্ধ হচ্ছে না। মানবাধিকার সংস্থা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, দেশের বিচার ব্যবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর মানুষের আস্থাহীনতা মব জাস্টিসের প্রবণতা বাড়াচ্ছে।
আইন নিজের হাতে তোলার প্রবণতা
মব জাস্টিস বা জনতার বিচার কোনো নতুন ঘটনা নয়। দীর্ঘদিন ধরে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী কিংবা শিশু অপহরণকারী সন্দেহে মানুষকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এ ধরনের ঘটনা নতুন মাত্রা পেয়েছে।
৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের ওপর হামলা, থানায় অগ্নিসংযোগ এবং পুলিশের মনোবলে ভাঙন ধরেছে। এ সুযোগে উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিজেদের ইচ্ছেমতো আইন প্রয়োগের চেষ্টা করছে।
খাগড়াছড়ির ঘটনা
সর্বশেষ খাগড়াছড়ির ঘটনায় জনতার হাতে পিটিয়ে মারা হয় এক স্কুলশিক্ষককে। স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ এনে ওই শিক্ষককে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই পিটিয়ে হত্যা করা হয়। স্থানীয় একদল যুবক এই হামলা চালায়।
এ ঘটনা দেশের বিভিন্ন স্তরে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে।
পুলিশ প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. ময়নুল ইসলাম জানান, “কিছু উচ্ছৃঙ্খল ঘটনা ঘটছে, তবে আমরা খবর পেলেই দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যাচ্ছি।”
তিনি বলেন, মব জাস্টিসের ঘটনা রোধে পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সত্ত্বেও, কিছু জায়গায় পুলিশের দ্রুত উপস্থিতির অভাব ঘটনার বিস্তার ঘটাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে গণপিটুনিতে কয়েকজন পুলিশ সদস্যও নিহত হয়েছেন। পুলিশ বাহিনী নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
মামলা ও গ্রেপ্তারের সংকট
মব জাস্টিসের ঘটনায় মামলা ও গ্রেপ্তারের হার অত্যন্ত কম। বেশিরভাগ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। গ্রেপ্তার হলেও তা খুবই সীমিত।
যদিও পুলিশের তথ্য মতে, গত দুই মাসে মব জাস্টিসের ঘটনায় অন্তত ২৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে, তবে এই হত্যাকাণ্ডগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থানায় মামলা হয়নি। গ্রেপ্তারও হাতে গোনা কয়েকজন। এই বাস্তবতায়, ভুক্তভোগীরা বিচার পাওয়ার আশাও হারিয়ে ফেলছেন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে ৮০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত সাড়ে ছয় বছরে আরও ২৮৬ জন নিহত হয়েছেন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, মব জাস্টিসের ঘটনা মূলত মানুষের মধ্যে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হ্রাসের প্রতিফলন। তারা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা রোধে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে।
বড় তিন হত্যাকাণ্ড
সম্প্রতি তিনটি হত্যাকাণ্ড সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে মোবাইল চোর সন্দেহে এক যুবক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
রাজশাহীর আবদুল্লাহ আল মাসুদের এক পা কেটে ফেলা হয়েছিল ছাত্রজীবনে। তিনি সন্তানের জন্য ওষুধ আনতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হন। এসব ঘটনায় মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
মব জাস্টিসের পরিণতি
এমতাবস্থায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে মারাত্মক সংকটে পড়েছে, তা স্পষ্ট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা দেশের সামাজিক শৃঙ্খলাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. উমর ফারুক বলছেন, “কোনো ঘটনা ঘটলে তার জন্য প্রচলিত আইন রয়েছে। আইন অনুযায়ী বিচার না হলে সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে না।”
অন্তর্বর্তী সরকারের আহ্বান
১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মব জাস্টিস বন্ধের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কেউ সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।”
হাইকোর্টের রিট
মব জাস্টিসের ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। রিটে এসব ঘটনা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেছেন, “পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এসব ঘটনার প্রধান কারণ। অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় না আনা হলে এরকম ঘটনা বাড়তে থাকবে।”
সামাজিক নিরাপত্তার সংকট
এ পরিস্থিতি দেশের সামাজিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং আইনের শাসনের অভাবে মব জাস্টিসের ঘটনা বাড়ছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
মব জাস্টিসে যারা শিকার হচ্ছে, তাদের পরিবার পরিজনেরাও বিচার না পেয়ে নীরব থেকেছেন। মামলা না করাই তাদের জন্য নিরাপত্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।