উত্তরপ্রদেশের হাথরাস জেলার ডিএল পাবলিক স্কুলে এক ১১ বছরের ছাত্রকে ‘বলি’ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ এখনও পর্যন্ত এই ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে রয়েছেন স্কুলের ম্যানেজার দীনেশ বাঘেল, তার বাবা যশোধন বাঘেল, প্রিন্সিপাল লক্ষ্মণ সিং এবং আরও দুই শিক্ষক।
ছাত্রের বাবা-মা ও স্থানীয়দের অভিযোগ, কৃতার্থ কুশওয়াহা নামের এই ছাত্রকে এক অন্ধবিশ্বাসের কারণে ‘বলি’ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়রা বিশ্বাস করতে পারছেন না যে এমন একটি আধুনিক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। গ্রামবাসীরা স্তম্ভিত।
অভিযুক্তদের দাবি অনুযায়ী, তারা এই হত্যার সাথে জড়িত নয়, কিন্তু পুলিশ প্রাথমিক তদন্তের মাধ্যমে বলির সম্ভাবনাকে সামনে এনে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে।
রহস্যজনক মৃত্যু
প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ডিএল পাবলিক স্কুলের ছাত্রাবাসে আবাসিক ছাত্র কৃতার্থ কুশওয়াহা মারা যায়।
তদন্তে উঠে এসেছে, ২৩ সেপ্টেম্বর সকালে কৃতার্থের মৃতদেহ স্কুলের ম্যানেজার দীনেশ বাঘেলের গাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়। তার গলায় গাঢ় লাল দাগ ছিল এবং ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী, তার শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।
তদন্তের সময় পুলিশ জানিয়েছে যে যশোধন বাঘেল, যিনি স্থানীয়ভাবে ‘ভগত জি’ নামে পরিচিত একজন ওঝা, এই হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী। তিনি স্কুলের উন্নতির জন্য ‘বলি’ দেওয়ার পদ্ধতি ব্যবহার করতেন বলে ধারণা করছে পুলিশ।
যশোধন বাঘেল আগে তন্ত্র-মন্ত্র এবং ঝাড়ফুঁকের কাজ করতেন। যদিও তিনি শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়ার পর এই কাজ থেকে সরে আসেন, তবে তার তান্ত্রিক কাজকর্ম সম্পর্কে তার পরিবার ও স্থানীয়দের মনে এখনো ভয় রয়ে গেছে।
পুলিশের বক্তব্য
হাথরাস পুলিশের তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে তারা বলির সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু পরিস্থিতিগত প্রমাণ পেয়েছে।
তবে পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অশোক কুমার সিং জানিয়েছেন, তদন্ত এখনও চলছে এবং আরও তথ্য বের হতে পারে।
পুলিশ এখন পর্যন্ত যশোধন বাঘেলকে ‘তান্ত্রিক’ বলে সন্দেহ করছে এবং তার ভূমিকা খতিয়ে দেখছে। যদিও এই বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ এখনো মেলে নি, তদন্ত জোরালোভাবে এগিয়ে চলছে।
তদন্তের পাশাপাশি স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্কুলের প্রাঙ্গণ সিল করা হয়েছে এবং ছাত্রাবাস বন্ধ রাখা হয়েছে।
শিশুটির বাবা-মায়ের ক্ষোভ
নিহত ছাত্র কৃতার্থ কুশওয়াহার বাবা কৃষ্ণা কুশওয়াহা পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি তার সন্তানের হত্যার পর বিচার দাবি করে চলেছেন।
কৃষ্ণা কুশওয়াহা বলেন, “একবিংশ শতাব্দীতে কীভাবে এমন নৃশংস বলির ঘটনা ঘটে? এটা কল্পনাও করা যায় না। আমার ছেলের হত্যার পিছনে আরও বড় ষড়যন্ত্র রয়েছে। তদন্ত করে পুরো সত্য উদঘাটন করা উচিত।”
ছাত্রের মা কমলেশ কুশওয়াহা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
তিনি বলেন, “অনেক আশা নিয়ে ছেলেকে স্কুলের ছাত্রাবাসে পাঠানো হয়েছিল। আমরা জানতাম না যে সেই স্কুলেই তাকে হত্যা করা হবে।”
প্রাক্তন ছাত্রদের অভিযোগ
এই ঘটনায় ডিএল পাবলিক স্কুলের ছাত্রাবাস সম্পর্কে পুরনো কিছু অভিযোগও সামনে এসেছে।
বাহারদোই গ্রামের দুই ছাত্রের পরিবার জানিয়েছে যে তাদের সন্তানদেরও শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।
৬ সেপ্টেম্বরের রাতে, একজন ৯ বছরের ছাত্রের গলায় গভীর আঘাতের দাগ পাওয়া যায়। তার পরিবার জানিয়েছে যে ছাত্রাবাসের ভিতরে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।
একইভাবে, ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে আরও এক শিক্ষার্থীর গলায় দড়ি দিয়ে শ্বাসরোধ করার অভিযোগ উঠেছে।
এই দুই ছাত্রও অভিযুক্ত যশোধন বাঘেলকে বলির ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করেছে। তাদের মতে, যশোধন বাঘেল রাতে ছাত্রাবাসে থাকতেন এবং ছাত্রদের উপর নজর রাখতেন।
বেআইনি ছাত্রাবাস
ডিএল পাবলিক স্কুলের ছাত্রাবাস সম্পর্কে নতুন তথ্য পাওয়া গেছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, স্কুলটি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অনুমোদিত হলেও সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হচ্ছিল।
এছাড়াও, ছাত্রাবাসের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি না নিয়ে বেআইনিভাবে এই প্রতিষ্ঠানটি চালানো হচ্ছিল।
নিহত ছাত্রের মৃত্যুর পর জেলা প্রশাসন স্কুলের স্বীকৃতি বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছে এবং বেআইনিভাবে ছাত্রাবাস পরিচালনার জন্য মামলা দায়ের করা হয়েছে।
অভিযুক্তদের বক্তব্য
অভিযুক্তদের পরিবার স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ডিএল পাবলিক স্কুলের নামকরণ করা হয়েছে ডোরিলাল বাঘেলের নামে, যিনি যশোধন বাঘেলের বাবা। তিনি দাবি করেছেন যে তার ছেলে ও নাতি মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছে।
“আমার ছেলে আর নাতি জেলে আছে। আমাদের কথা শোনার কেউ নেই,” বলেছেন ডোরিলাল বাঘেল।
যশোধন বাঘেলের মেয়ে বিনীতা বাঘেল দাবি করেছেন, “আমার বাবা কোনো তান্ত্রিক নন। তিনি একজন ধার্মিক ব্যক্তি এবং আচার-অনুষ্ঠান করতে অভ্যস্ত। কিন্তু এর সঙ্গে তন্ত্র-মন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই।”
স্কুল ম্যানেজার দীনেশ বাঘেলের মা শকুন্তলা বাঘেল বলেন, “আমার ছেলে মালয়েশিয়ায় চাকরি পেয়েও ফিরে এসে স্কুল তৈরি করেছিল। নিজের পরিশ্রমে তৈরি স্কুলে কেন সে এমন একটি কাজ করবে?”
এলাকাবাসীর প্রতিক্রিয়া
হাথরাসের রসগাওয়াঁ গ্রামের আশেপাশের এলাকাগুলির অনেক অভিভাবক সন্তানের শিক্ষার জন্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুলকে অগ্রাধিকার দেন।
ডিএল পাবলিক স্কুলের মতো আধুনিক স্কুলগুলি গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে বলে স্থানীয়দের মত।
তবে এই চাঞ্চল্যকর ঘটনার পর, অনেক অভিভাবকই তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
স্কুলটির সিল করার ফলে প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা বলছে, সরকার এই ছাত্রদের বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তদন্তের অপেক্ষা
হাথরাস পুলিশ জানিয়েছে, এই ঘটনায় আরও অনেক তথ্য তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে।
নিহত ছাত্রের পরিবার এবং স্থানীয় সমাজ এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি দাবি করেছে।
উত্তরপ্রদেশ সরকারও এই ঘটনাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে এবং মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ঘটনাটির তদন্তের তত্ত্বাবধান করছেন।
অবশেষে, এই ঘটনার সত্যতা এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পুলিশ এবং প্রশাসনের ভূমিকা এখন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে এলাকাবাসী।