ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনি প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন হেজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসারুল্লাহর মৃত্যুতে। শুক্রবার ইসরায়েলের হামলায় লেবাননের ইরানপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের নেতা নিহত হন। এই ঘটনার পর ইরান পাঁচ দিনের শোক ঘোষণা করেছে এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি সভা ডাকার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, নাসারুল্লাহর মৃত্যু ‘প্রতিশোধহীন যাবে না’। তাঁর মতে, ইসরায়েলের এই হামলা শুধু হেজবুল্লাহকে নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এই মৃত্যুর পর ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।
হাসান নাসারুল্লাহ, যিনি ১৯৯২ সাল থেকে হেজবুল্লাহর নেতৃত্বে ছিলেন, ইসরায়েল-লেবানন সংঘাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নাসারুল্লাহর হত্যাকাণ্ডকে ‘ঐতিহাসিক মোড় ঘুরানো ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং জানিয়েছেন, এটি ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য এক বড় সাফল্য। তবে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, ‘এখনও চূড়ান্ত বিজয়ের সময় আসেনি।’
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই হত্যাকাণ্ডকে ‘ন্যায়বিচারমূলক পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত প্রয়োজনীয় ছিল, কারণ নাসারুল্লাহ ও তাঁর দল বহুদিন ধরে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে আসছে এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
হেজবুল্লাহর প্রতিক্রিয়া: পাল্টা আঘাতের প্রস্তুতি
হাসান নাসারুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের পর হেজবুল্লাহ ঘোষণা দিয়েছে যে তারা তাদের নেতা হত্যার প্রতিশোধ নেবে। দলটি জানিয়েছে, তাদের হাজার হাজার যোদ্ধা প্রতিশোধের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। সিরিয়ায় যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অনেক যোদ্ধা রয়েছে, যারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত।
যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মেদ আল-বাশা বলেছেন, “নাসারুল্লাহর মৃত্যুর ফলে হেজবুল্লাহর অভ্যন্তরে সংকট দেখা দিলেও তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি পুরোপুরি নিস্তেজ হবে না। বরং তারা আরও শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।” তবে তিনি আরও যোগ করেন, “ইসরায়েলকে পাল্টা আঘাত দিতে গিয়ে হেজবুল্লাহ যদি বেসামরিক নাগরিকদের উপর হামলা করে, তবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ।”
হেজবুল্লাহর সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তাদের এখনও পর্যাপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ আছে, যা ইসরায়েলের তেল আবিবসহ বিভিন্ন শহরে আঘাত হানতে পারে। তবে ইসরায়েলের শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাদের অনেক ক্ষেপণাস্ত্রকে ভেদ করতে পারে না, যা হেজবুল্লাহর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ইরানের ভূমিকা: কঠিন প্রতিক্রিয়ার প্রস্তুতি
হেজবুল্লাহর মতো ইরানও নাসারুল্লাহর মৃত্যুতে কঠোর প্রতিক্রিয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইরান ইতোমধ্যেই পাঁচ দিনের শোক ঘোষণা করেছে এবং তাদের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনিকে নিরাপত্তার কারণে একটি গোপন স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তেহরানের গেস্ট হাউজে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিয়ে আলোচনা চলছে এবং বিভিন্ন সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
ইরানের সঙ্গে যুক্ত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইতোমধ্যেই প্রস্তুত রয়েছে। ইয়েমেনের হুতিরা, সিরিয়ার বিভিন্ন শিয়া গোষ্ঠী এবং ইরাকের মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো এই আঘাতের পাল্টা প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত। ইরানের সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনার পর ইরান তাদের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে ইসরায়েল এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে আঘাত করার চেষ্টা করতে পারে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান যদি সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো বড় আঘাত হানে, তবে সেটি পুরো অঞ্চলে একটি বৃহত্তর যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক শক্তি জড়িয়ে পড়তে পারে, যা গোটা অঞ্চলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া: সামরিক অভিযানের বিস্তার
ইসরায়েল ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে তারা হেজবুল্লাহর ওপর তাদের সামরিক অভিযান চালিয়ে যাবে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা হেজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকি পুরোপুরি দূর না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চালাতে প্রস্তুত। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘হেজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান আরও বিস্তৃত হতে পারে, যদি তারা ইসরায়েলের উপর আরও আঘাত হানে।’
ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) ইতোমধ্যেই তাদের পদাতিক বাহিনীকে সীমান্তে প্রস্তুত রেখেছে। সীমান্ত এলাকায় হেজবুল্লাহর স্থাপনা এবং অস্ত্রাগারগুলোতে হামলা চালানো হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল হেজবুল্লাহকে পুরোপুরি নিঃশেষ করতে চাইলে লেবাননে বড় ধরনের স্থল অভিযান চালাতে হতে পারে, যা ইসরায়েলি বাহিনীর জন্য সহজ হবে না।
আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই হত্যাকাণ্ডের পর মধ্যপ্রাচ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া এসেছে। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, ইসরায়েল এবং হেজবুল্লাহর সংঘর্ষের কারণে লেবানন থেকে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পালিয়ে সিরিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে। লেবাননের অভ্যন্তরে দুই লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হলেও ইসরায়েল এবং হেজবুল্লাহ উভয়ই তাদের সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন দুই পক্ষকে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সংঘাতের সমাধান করার আহ্বান জানিয়েছে, তবে এর সম্ভাবনা আপাতত ক্ষীণ বলেই মনে হচ্ছে।
সম্পাদকীয় বিশ্লেষণ: মধ্যপ্রাচ্যের অস্থির ভবিষ্যৎ
হাসান নাসারুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত আরও তীব্রতর হলো। এটি শুধু লেবানন এবং ইসরায়েলের মধ্যকার সীমান্ত সংঘাত নয়, বরং ইরান এবং ইসরায়েলের দীর্ঘস্থায়ী আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার আরও একটি পর্বের সূচনা। নাসারুল্লাহ ছিলেন ইরানের অন্যতম শক্তিশালী সহযোগী এবং তাঁর নেতৃত্বে হেজবুল্লাহ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালিয়ে এসেছে।
নাসারুল্লাহর মৃত্যুর পর হেজবুল্লাহর নেতৃত্ব এবং তাদের সামরিক কৌশল কীভাবে পরিবর্তিত হবে, সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এটি নিশ্চিত যে হেজবুল্লাহ সহজে তাদের সংগ্রাম থেকে সরে আসবে না। ইরানের সমর্থনে তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নতুন করে আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা সংঘাতকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে।
ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি সংঘাতের সম্ভাবনাও বেড়ে গেছে। ইরান যদি হেজবুল্লাহর হত্যার প্রতিশোধ নিতে সরাসরি ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ করে, তবে সেটি পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে একটি বড় যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।