বিশ্ব সম্প্রদায়কে নতুন বাংলাদেশের সাথে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯-তম অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে তিনি এ আহ্বান জানান।
শুক্রবার নিউইয়র্ক সময় সকালে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূস তার প্রথম ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক সংকট ও বৈশ্বিক উন্নয়নের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। বক্তৃতার শুরুতে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়-ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে – এটাই আমাদের লক্ষ্য।” তিনি বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিবর্তনকে ‘মনসুন রেভোল্যুশন’ বা ‘মনসুন অভ্যুত্থান’ বলে আখ্যা দেন, যা সাম্প্রতিক আন্দোলনের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার পতনের ইঙ্গিত করে।
একাত্তরের মূল্যবোধ এবং প্রজন্ম জি
অধ্যাপক ইউনূস তার ভাষণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, “১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে আমাদের জনগণ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পরে আমাদের ‘জেনারেশন জি’ (প্রজন্ম জি) নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে।”
তার মতে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট এবং নতুন প্রজন্মের সংগ্রাম আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও মৌলিক অধিকারগুলোকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। ছাত্র ও যুব সমাজের আন্দোলনকে তিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেন।
তিনি আরও বলেন, “আমাদের ছাত্র জনতা তাদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছে।”
নতুন বাংলাদেশের সংজ্ঞা
বাংলাদেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, সকল রাজনৈতিক দলকে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, “আমরা মানুষের মৌলিক অধিকারকে সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়-ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে – এটাই আমাদের লক্ষ্য।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, তার সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রব্যবস্থার সকল পর্যায়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনা এবং জনগণের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এছাড়া, তিনি চলমান রাজনৈতিক সংস্কারের গুরুত্ব এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নের ওপর জোর দেন।
ইসরায়েল-গাজা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে
অধ্যাপক ইউনূস তার ভাষণে ইসরায়েল-গাজা এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি গাজায় চলমান সংঘাতকে মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবে আখ্যা দেন এবং ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, “বিশ্ববাসীর উদ্বেগ এবং নিন্দা সত্ত্বেও গাজায় গণহত্যা থামছে না। ফিলিস্তিনের বিদ্যমান বাস্তবতা কেবল আরব কিংবা মুসলমানদের জন্যই উদ্বেগজনক নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্যই উদ্বেগের বিষয়।”
তিনি ফিলিস্তিনে দুই-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানকে মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তির একমাত্র পথ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। এছাড়াও, তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন।
অর্থ পাচার, রোহিঙ্গা ইস্যু এবং অভিবাসন প্রসঙ্গ
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় সংকট অর্থ পাচারের প্রসঙ্গও উঠে আসে মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে। তিনি উল্লেখ করেন যে, উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে অবৈধ অর্থের প্রবাহ বন্ধ করতে এবং পাচার হয়ে যাওয়া সম্পদ ফেরত আনার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। এছাড়া, তিনি কর ফাঁকি রোধে আন্তর্জাতিক কর কনভেনশনের গৃহীত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
অধ্যাপক ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও বক্তব্য রাখেন এবং বলেন, “রোহিঙ্গারা যাতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করে তাদের নিজ ভূমি – রাখাইনে – ফিরে যেতে পারে, তার পথ সুগম করা দরকার।”
তিনি অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং অনিরাপদ অভিবাসন রোধে তার সরকারের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যালেঞ্জ
অধ্যাপক ইউনূস কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদ্ভাবন ও এর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মতো বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠীর দেশ যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগজনিত অর্জিত সুফল থেকে পিছিয়ে না পড়ে, বিশ্ব সম্প্রদায়কে তা নিশ্চিত করতে হবে।”
তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে মানুষের চাহিদা সংকুচিত হওয়ার বিষয়েও বিশ্ব সম্প্রদায়কে সতর্ক করেন এবং অটোনমাস ইন্টেলিজেন্সের (স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তা) কারণে মানবিক অস্তিত্বের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বিশ্বনেতাদের সাথে বৈঠক
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে অধ্যাপক ইউনূস ২৪শে সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে তিনি বিভিন্ন রাষ্ট্র, সরকার ও সংস্থার প্রধানদের সাথে বৈঠক করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ আরও অনেক বিশ্বনেতার সাথে সাক্ষাৎ করেন।
সম্পাদনা বিশ্লেষণ: নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণটি বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এটি শুধু বাংলাদেশকেই নয়, বরং বৈশ্বিক সম্প্রদায়কেও নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত করেছে। তবে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য ও সম্ভাবনাগুলো বাস্তবায়ন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদল এবং গণতান্ত্রিক পুনর্জন্মকে বিশ্বের সাথে সম্পৃক্ত করার এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা একটি জটিল কাজ। দেশের জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে কথা বলার সুযোগ দিতে হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা জরুরি।
ইসরায়েল-গাজা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতি ও কূটনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের বৈশ্বিক ইস্যুগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রেখে কার্যকর কূটনীতি গড়ে তোলাও একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।
অর্থ পাচার এবং রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান নিয়ে সরকারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন হবে।
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আস্থায় রাখতে হলে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিকভাবে দক্ষ নেতৃত্ব ও সঠিক নীতি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।