ড. মুহাম্মদ ইউনূস
,

মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগে মামলা: সমাজে ক্ষমতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে কটূক্তি এবং হত্যার হুমকির অভিযোগে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ২৬শে অক্টোবর স্থানীয় জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আশীষ রায়ের আদালতে দায়ের করা এই মামলাটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও পেনাল কোডের অধীনে নথিভুক্ত করা হয়। মামলার বাদী পূর্ব মধুখালী গ্রামের বাসিন্দা হাসান মাহমুদ অভিযোগ করেন, ফেসবুকে দেওয়া এক মন্তব্যের মাধ্যমে আসামি মো. মাসুম বিল্লাহ মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্য করেছেন এবং তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন।

এ ঘটনা নিয়ে ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের করা দ্বিতীয় মামলা। বিগত সরকারের আমলেও এমনভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলার অভিযোগের প্রবণতা দেখা গিয়েছিল, যা এখনো থামেনি।

মামলার প্রকৃত ঘটনা

ঘটনার সূত্রপাত হয় চলতি বছরের ২ মে, যখন মুহাম্মদ ইউনূস আদালতে হাজিরা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন। পরে বেসরকারি টেলিভিশন সময় টিভি ওই বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে। ওই ভিডিওতে আসামি মাসুম বিল্লাহ একটি মন্তব্য করেন, যেখানে তিনি মুহাম্মদ ইউনূসকে আমেরিকার দালাল বলে কটূক্তি করেন। মামলার অভিযোগে আরও বলা হয়, মাসুম বিল্লাহ স্থানীয় এলাকায়ও মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে আপত্তিকর ভাষা ব্যবহার করেন এবং তাকে গুলি করে হত্যা করার হুমকি দেন।

মামলার আইনজীবী হাফিজুর রহমান চুন্নু বলেন, আদালত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সরাসরি মামলা গ্রহণ না করে বিষয়টি তদন্তের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। পেনাল কোডের অন্যান্য ধারার ভিত্তিতে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে পুলিশ পরবর্তীতে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবে।

মানহানি ও হুমকির মামলায় আইনি জটিলতা

বাংলাদেশের মানহানি সম্পর্কিত আইনগুলোর মধ্যে রয়েছে একাধিক বিতর্ক। পেনাল কোডের ৪৯৯ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কারও সুনাম নষ্ট করার জন্য মন্তব্য করেন, তবে তা মানহানি হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়েরের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিই প্রথমে অভিযোগ করতে পারেন। তবে এই ধরনের মামলায় তৃতীয় পক্ষের মামলা করার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, “তৃতীয় পক্ষের মানহানির মামলা নেওয়ার বিষয়ে আইন কিছুটা অস্পষ্ট। বিশেষ করে, যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি নিজেই মামলা করেননি, সেখানে তৃতীয় পক্ষের অভিযোগ তোলা উচিত নয়।”

আদালত ও ক্ষমতার সম্পর্ক

মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে এই মামলাগুলো নিয়ে বিতর্ক শুধু তার ব্যক্তিগত মানহানির প্রসঙ্গে নয়, বরং বাংলাদেশের আদালতগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ে আদালতে বারবার এ ধরনের মানহানি মামলা হওয়ার প্রবণতা নিয়ে আলোচনা বাড়ছে।

রাজনীতি বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বলেন, “বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থায় মানহানি বা সমালোচনা নিয়ে মামলা দায়েরের প্রবণতা নতুন কিছু নয়। তবে এই ঘটনা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে ক্ষমতা ও বিচার ব্যবস্থার মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “অতীতে দেখা গেছে, সরকার ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের সমালোচনা করার পর প্রায়শই মামলা দায়ের করা হতো। অনেক সময় মামলা গ্রেফতার ও হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ক্ষমতার প্রশ্নে সামাজিক প্রতিরোধের এই ধরনের দৃষ্টান্তগুলি সমাজে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করছে।”

আইনের অপব্যবহার

এই মামলা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো অন্যান্য আইনের অপব্যবহার নিয়ে বহু বছর ধরেই সমালোচনা হয়ে আসছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, যা সাম্প্রতিক সময়ে সাইবার নিরাপত্তা আইনে রূপান্তরিত হয়েছে, বারবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

মামলার আসামি মাসুম বিল্লাহ অভিযোগ করেন যে বাদী হাসান মাহমুদ তাকে ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে মামলা করেছেন। “এটা একেবারেই ভিত্তিহীন এবং কাল্পনিক ইস্যু,” বলে তিনি মন্তব্য করেন।

আইনজীবী সারা হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, “এই ধরনের আইনি ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল স্বাধীন মতপ্রকাশের সুরক্ষা, কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় এসব আইনকে ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে।”

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকট

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে মানহানির মামলার সংখ্যা বাড়তে থাকা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলছে। বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সমালোচনাকে সহজভাবে গ্রহণ না করার প্রবণতা সমাজে মতপ্রকাশের অধিকারকে সংকুচিত করছে।

মিজ রাশেদা রওনক খান বলেন, “সমালোচনাকে প্রশংসার মতোই গ্রহণ করা শাসক ও নেতাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। উন্নত দেশগুলোতে আমরা দেখি যে শাসকরা নিয়মিতভাবেই সমালোচনার মুখে পড়েন এবং তা মেনে নেন। কিন্তু আমাদের দেশে অনেকেই সমালোচনাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ হিসেবে নেন।”

তিনি আরও বলেন, “ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম মূল ভিত্তি হওয়া উচিত।”

আইনের সংস্কার ও ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশে বর্তমান আইনি ব্যবস্থায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্কের মূলে রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং মানহানির মামলা নিয়ে সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর অপব্যবহার। এ ধরনের মামলাগুলোর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং এগুলো রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করা হয়।

আইনজীবী সারা হোসেন মনে করেন, “মানহানির জন্য পেনাল কোডের অধীনে থাকা ধারা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিধানগুলোর মধ্যে একটি ভারসাম্য দরকার। যদি আইনগুলোকে অপব্যবহার করা হয়, তাহলে তা বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী হবে।”

তিনি আরও বলেন, “সাইবার নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং স্বাধীন তদন্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের মামলাগুলোতে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে স্বাধীন তদন্ত ব্যবস্থার প্রয়োজন।”

সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ: ক্ষমতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা এবং এই মামলাকে ঘিরে বিতর্ক বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিচ্ছবি। একদিকে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং অন্যদিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংঘর্ষ নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তা গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের ওপর একটি গভীর প্রশ্ন তুলেছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সমালোচনা এবং বিরোধিতার স্বাধীনতা বরাবরই সীমিত ছিল। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে সমালোচনা করার ফলে মামলার শিকার হওয়ার ঘটনা কোনো নতুন ব্যাপার নয়। ক্ষমতার দাপট এবং আইনের অপব্যবহার কীভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করে, তা এই ঘটনাগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়।

আসলে, সমালোচনা এবং বিরোধিতা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। সরকারের এবং নেতৃবৃন্দের উচিত জনগণের বক্তব্যকে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করা এবং তাদের মতামতকে বোঝার চেষ্টা করা। শুধুমাত্র আইন ও নীতি সংস্কার নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতার সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারকে সম্মান জানানো, এবং সেই সাথে মতপ্রকাশের জন্য যারা ভয় পাচ্ছেন তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহসী উদ্যোগ। ক্ষমতাসীনদের উচিত সমালোচনাকে গ্রহণ করার সংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।

আরও পড়তে পারেন