চেন্নাইয়ের এম এ চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্টে রবি চন্দ্রন অ্যাশউইনের দুর্দান্ত বোলিংয়ে বাংলাদেশ ২৮০ রানে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়েছে। ভারতের নির্ধারিত ৫১৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ চতুর্থ দিনে মাত্র ২৩৪ রানে গুটিয়ে যায়। বাংলাদেশ দলের পক্ষে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত ৮২ রানের লড়াকু ইনিংস খেলেন, কিন্তু তার প্রতিরোধও দলকে পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। দুই ম্যাচের সিরিজে ভারত ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল।
অ্যাশউইনের অলরাউন্ড নৈপুণ্য
ভারতের এই জয়ে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল তাদের স্পিনার রবি চন্দ্রন অ্যাশউইনের, যিনি চেন্নাইয়ের ঘরের মাঠে নিজের সেরা ফর্মে ছিলেন। ব্যাট হাতে প্রথম ইনিংসে ১১৩ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলার পর, বল হাতেও তিনি একইরকম সফল ছিলেন। দুই ইনিংস মিলিয়ে ১০ উইকেট শিকার করে অ্যাশউইন ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় ইনিংসে ৬ উইকেট নিয়ে তিনি বাংলাদেশ ব্যাটিং অর্ডারকে পুরোপুরি ভেঙে দেন। বিশেষত, চতুর্থ দিনের শুরুতেই অ্যাশউইনের বোলিংয়ে বাংলাদেশ দ্রুত উইকেট হারায়, যা ম্যাচের গতিপথ সম্পূর্ণ ভারতের দিকে নিয়ে যায়।
ভারতের প্রথম ইনিংসের দাপট
ভারতের প্রথম ইনিংসে রবি চন্দ্রন অ্যাশউইন ছাড়াও, রবি জাদেজা দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করেন। ৮৬ রানের ইনিংস খেলে তিনি অ্যাশউইনের সঙ্গে ৯৯ রানের গুরুত্বপূর্ণ পার্টনারশিপ গড়েন। এই ইনিংসে ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ দৃঢ়তার পরিচয় দেয়, যা বাংলাদেশকে শুরু থেকেই চাপের মধ্যে ফেলে।
ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে শুবমান গিল এবং ঋষভ পান্তের সেঞ্চুরি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ভারতের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করে। গিল অপরাজিত ১১৯ রান করেন, আর দীর্ঘদিন পর ইনজুরি থেকে ফিরে আসা ঋষভ পান্ত খেলেন ১০৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। পান্ত ও গিলের মধ্যে চতুর্থ উইকেটে ১৬৭ রানের জুটি প্রতিপক্ষকে ম্যাচ থেকে কার্যত ছিটকে দেয়। তৃতীয় দিনেই ভারত তাদের দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করে ২৮৭-৪ রানে।
বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের লড়াই ও পতন
৪র্থ দিনের শুরুতে ১৫৮-৪ থেকে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেছিল বাংলাদেশ। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত এবং অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান প্রথম ঘন্টায় ভারতীয় বোলারদের ভালোই প্রতিরোধ করেন। শান্তর ব্যাটিং বিশেষ প্রশংসাযোগ্য ছিল, তিনি এক প্রান্ত ধরে রেখে সাহসী ইনিংস খেলেন।
কিন্তু রোহিত শর্মা চতুর্থ দিনে বল হাতে আনার জন্য অ্যাশউইনকে ডেকে পাঠান, এবং তিনি প্রথম ওভারেই সাকিব আল হাসানের উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন। সাকিবের (২৫ রান) আউটের পর থেকে বাংলাদেশের ব্যাটিং দ্রুত ভেঙে পড়ে। অ্যাশউইনের বোলিংয়ে সাকিবকে ব্যাট-প্যাড ক্যাচে ফাঁদে ফেলে শর্ট লেগে ক্যাচ তুলে নেন যশস্বী জয়সওয়াল।
এরপর রবি জাদেজা লিটন দাসকে স্লিপে ক্যাচ আউট করেন এবং তার কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্তকে আউট করে বাংলাদেশের প্রতিরোধের শেষটুকু ভেঙে দেন। শান্ত ৮২ রান করলেও তাকে যোগ্য সঙ্গ দিতে পারেননি দলের অন্য ব্যাটসম্যানরা। একের পর এক উইকেট পতনের মধ্যে বাংলাদেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, এবং ম্যাচটি শেষ হয়ে যায় পাঁচ সেশন বাকি থাকতেই।
বাংলাদেশ দলের সংগ্রাম
বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে শান্তর ইনিংস ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। প্রথম ইনিংসে তারা মাত্র ১৪৯ রানে অলআউট হয়েছিল, যেখানে ভারতের বোলাররা, বিশেষত জসপ্রিত বুমরাহর নেতৃত্বে, বাংলাদেশকে চাপে রাখেন। বাংলাদেশ ব্যাটিং অর্ডার ভারতের স্পিন ও পেস আক্রমণের সামনে ভেঙে পড়ে।
বাংলাদেশ দলের ইতিবাচক দিক ও শঙ্কা
বাংলাদেশ এই টেস্টে হারলেও কিছু ইতিবাচক দিক ছিল। পাকিস্তানের বিপক্ষে সদ্য শেষ হওয়া সিরিজ জয়ের আত্মবিশ্বাস নিয়ে তারা ভারত সফরে এসেছিল। তবে ভারতীয় বোলিং আক্রমণের সামনে তাদের ব্যাটিংয়ের দুর্বলতা প্রকটভাবে ধরা পড়ে। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় এবং দ্বিতীয় ইনিংসে শান্ত ছাড়া কেউ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি।
তবে শান্ত এবং সাকিবের জুটি কিছুটা প্রতিরোধ গড়লেও তা জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল না। টেস্ট ক্রিকেটে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশ দলকে তাদের ব্যাটিং শক্তি এবং গভীরতা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং ও বোলিং আক্রমণের সামনে আরও দৃঢ় প্রতিরোধের প্রয়োজন ছিল, যা এই ম্যাচে দেখা যায়নি।
ভারতীয় দলে গুরুত্বপূর্ণ ফেরা
এই টেস্টে ভারতের হয়ে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ফিরে আসেন। উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান ঋষভ পান্ত এক বছরের বেশি সময় পর মাঠে ফিরে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি করেন। পান্তের এই প্রত্যাবর্তন ভারতের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। তার সঙ্গে শুবমান গিলের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দলকে বড় স্কোর গড়তে সহায়তা করে।
তাছাড়া সাবেক অধিনায়ক বিরাট কোহলিও তার দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর দলে ফিরে আসেন। তবে, এই ম্যাচে কোহলির পারফরম্যান্স আশানুরূপ ছিল না; তিনি ৬ ও ১৭ রান করে আউট হন। ভারতের বোলিং আক্রমণেও জসপ্রিত বুমরাহর নেতৃত্ব ছিল প্রশংসনীয়, কারণ তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে বড় সংগ্রহ গড়তে ব্যর্থ হয়।
অ্যাশউইনের ঐতিহাসিক অর্জন
এই ম্যাচে রবি চন্দ্রন অ্যাশউইন দুই ইনিংস মিলিয়ে ১০ উইকেট তুলে নেন, যা তাকে ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত করে। অ্যাশউইনের বোলিং দক্ষতা এবং বুদ্ধিমত্তা ভারতের টেস্ট দলে তাকে অপরিহার্য করে তুলেছে। তিনি ব্যাট হাতেও অসাধারণ পারফরম্যান্স করেন, ১১৩ রান করে প্রথম ইনিংসে ভারতের বড় স্কোর গড়তে সাহায্য করেন।
চেন্নাইয়ের এই ম্যাচে অ্যাশউইনের পারফরম্যান্স তাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার বোলিংয়ের বৈচিত্র্য, উইকেট নেওয়ার কৌশল এবং ধৈর্য তাকে ব্যাটসম্যানদের জন্য বিপজ্জনক করে তোলে।
দ্বিতীয় টেস্টের দিকে দৃষ্টি
প্রথম টেস্টে ভারতের দাপুটে জয়ের পর, দুই দল এবার দ্বিতীয় টেস্টের জন্য কানপুরে মুখোমুখি হবে। বাংলাদেশ দল এই টেস্টে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে এবং ভারতীয় আক্রমণের বিরুদ্ধে ভালো প্রতিরোধ গড়ার জন্য তাদের ব্যাটসম্যানদের বড় ভূমিকা রাখতে হবে।
ভারত অবশ্য নিজেদের জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে চাইবে এবং টেস্ট সিরিজে নিজেদের আধিপত্য প্রমাণ করার লক্ষ্যে মাঠে নামবে। প্রথম টেস্টে দুর্দান্ত পারফর্ম করা অ্যাশউইন এবং অন্যান্য বোলাররা পরের ম্যাচেও নিজেদের সেরা ফর্মে থাকবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।