হেজবুল্লাহ
,

হেজবুল্লাহ: লেবাননের শিয়া সংগঠনের উত্থান, প্রভাব এবং বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

হেজবুল্লাহ শব্দের অর্থ ‘সৃষ্টিকর্তার দল’। এটি লেবাননের শিয়া ইসলামপন্থী সংগঠন, যা রাজনৈতিক, সামরিক ও সামাজিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী। ১৯৮০-এর দশকে গোষ্ঠীটি আত্মপ্রকাশ করে, বিশেষত যখন লেবানন ইসরায়েলের দখলদারত্বের সম্মুখীন হয়। তবে, এর আদর্শিক শিকড় স্থাপিত হয় ষাট ও সত্তরের দশকে লেবাননে শিয়া পুনর্জাগরণের সময়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটি একটি বহুমাত্রিক দল হিসেবে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন, সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং শিয়া সম্প্রদায়ের জন্য সামাজিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে একটি বিশাল প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। গোষ্ঠীটির কর্মকাণ্ড লেবাননের জাতীয় রাজনীতিতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, বিশেষত তাদের সামরিক শাখা, ‘ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স’-এর মাধ্যমে।

হেজবুল্লাহর আত্মপ্রকাশ: শুরুর দিনগুলো

হেজবুল্লাহর প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলা কঠিন। তবে ১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসনের পর এর উত্থান ঘটে। লেবাননের শিয়া গোষ্ঠী আমল মুভমেন্ট থেকে একটি চরমপন্থী দল বেরিয়ে এসে ইসলামিক আমল নামে নতুন সংগঠন গঠন করে। তাদের লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করা। ইসলামিক আমলকে ইরানের রেভ্যুলশনারি গার্ড ব্যাপক সামরিক সহায়তা প্রদান করে, যা তাদের শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম প্রধান শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করে।

এই সময় থেকে, হেজবুল্লাহ শুধু ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়, অন্যান্য বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধেও লড়াই শুরু করে। ১৯৮৩ সালে সংগঠনটির বিরুদ্ধে মার্কিন দূতাবাস এবং ইউএস মেরিন ব্যারাকে বোমা হামলার অভিযোগ ওঠে, যা বহু মার্কিন ও ফরাসি কর্মীর মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। পরবর্তীতে পশ্চিমা শান্তিরক্ষী বাহিনী লেবানন থেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।

১৯৮৫ সালে হেজবুল্লাহ একটি ‘খোলা চিঠি’ প্রকাশ করে নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও আদর্শকে প্রকাশ করে। এতে তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ইসলামের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ইসরায়েলকে মুসলমানদের ভূমি দখলকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে। তারা ইসরায়েল ধ্বংসের আহ্বান জানায় এবং লেবাননে ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনগণের সমর্থনের আহ্বান জানায়।

সামরিক সক্ষমতা ও ‘ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স’

১৯৮৯ সালে স্বাক্ষরিত তায়েফ চুক্তির মাধ্যমে লেবাননের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে এবং সশস্ত্র সংগঠনগুলোর নিরস্ত্রীকরণে উদ্যোগ নেয়া হয়। হেজবুল্লাহ এই চুক্তির আওতায় এসে তাদের সামরিক শাখা রিব্র্যান্ড করে ‘ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স’ নামে পরিচিত করে। তারা যুক্তি দেয় যে, ইসরায়েলের দখলদারিত্বের কারণে তারা সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখবে।

১৯৯০-এর দশকে সিরিয়ার লেবাননে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় হেজবুল্লাহ দক্ষিণ লেবাননে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে এবং পাশাপাশি লেবাননের জাতীয় রাজনীতিতেও প্রবেশ করে। ১৯৯২ সালে তারা সফলভাবে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়। এর ফলে সংগঠনটি লেবাননের জনগণের মধ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।

২০০০ সালে ইসরায়েল যখন লেবানন থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে, এই বিজয়ের কৃতিত্ব হেজবুল্লাহকে দেয়া হয়। যদিও ইসরায়েলি বাহিনীর চলে যাওয়ার পরেও হেজবুল্লাহ তাদের সামরিক শাখাকে রক্ষা করে এবং নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। তাদের যুক্তি ছিল যে, ইসরায়েল এখনও লেবাননের কিছু অঞ্চলে উপস্থিত এবং তারা প্রতিরোধ অব্যাহত রাখবে।

২০০৬ সালের যুদ্ধ: হেজবুল্লাহর সামরিক সাফল্য

২০০৬ সালে হেজবুল্লাহর সশস্ত্র যোদ্ধাদের আক্রমণে আট ইসরায়েলি সেনা নিহত এবং দুইজন সেনা অপহৃত হয়। এর পরপরই ইসরায়েল হেজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ লেবানন এবং বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলে বিমান হামলা চালায়। হেজবুল্লাহ এর প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলের অভিমুখে প্রায় ৪০০০ রকেট ছোঁড়ে।

এই ৩৪ দিনব্যাপী সংঘর্ষে ১১২৫ জন লেবানিজ নাগরিক নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই ছিল বেসামরিক। ইসরায়েলের পক্ষে ১১৯ সেনা এবং ৪৫ বেসামরিক লোক নিহত হয়। যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও হেজবুল্লাহ টিকে যায় এবং যুদ্ধের পর আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে। এর ফলে সংগঠনটি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোচিত হতে শুরু করে এবং তাদের সামরিক সক্ষমতা অনেকের নজরে আসে।

হেজবুল্লাহর রাজনৈতিক উত্থান

২০০৮ সালে লেবাননের পশ্চিমা সমর্থিত সরকার হেজবুল্লাহর টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় হেজবুল্লাহ বৈরুতের অনেক অংশ দখল করে নেয় এবং সুন্নি গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষে ৮১ জন নিহত হয় এবং লেবানন প্রায় গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়।

এই সহিংসতা থামানোর লক্ষ্যে লেবানন সরকার হেজবুল্লাহর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি করতে বাধ্য হয়, যা সংগঠনটিকে মন্ত্রিসভায় ভেটো দেয়ার ক্ষমতা দেয়। ২০০৯ সালের নির্বাচনে হেজবুল্লাহ সংসদের ১০টি আসনে জিতে নেয় এবং সরকারে অংশগ্রহণ করে।

হেজবুল্লাহর সেক্রেটারি জেনারেল শেখ হাসান নাসরাল্লাহ ২০০৯ সালে নতুন রাজনৈতিক ইশতেহার ঘোষণা করেন, যা সংগঠনটির ‘পলিটিক্যাল ভিশন’ নামে পরিচিত। নতুন এই ইশতেহারে ১৯৮৫ সালের ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য বাদ দেয়া হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান অব্যাহত থাকে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে হেজবুল্লাহর অংশগ্রহণ

২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হলে হেজবুল্লাহ সরাসরি প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পক্ষ নিয়ে লড়াই শুরু করে। হেজবুল্লাহর হাজার হাজার সদস্য সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, বিশেষ করে লেবাননের সীমান্তবর্তী এলাকায় বিদ্রোহীদের হটিয়ে দেয়। হেজবুল্লাহর এই সামরিক তৎপরতা আসাদের সরকারকে টিকে থাকতে সাহায্য করে এবং ইরান ও সিরিয়ার সঙ্গে সংগঠনটির সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হয়।

বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া ও চ্যালেঞ্জ

হেজবুল্লাহর সামরিক ও রাজনৈতিক উত্থান আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল, হেজবুল্লাহকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। ২০০৫ সালে লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরির হত্যার ঘটনায় হেজবুল্লাহর চার সদস্য অভিযুক্ত হওয়ায় সংগঠনটি আরো বেশি সমালোচনার সম্মুখীন হয়।

আরব লীগ এবং বেশ কয়েকটি আরব দেশও হেজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ এবং ইরান ও সিরিয়ার সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হেজবুল্লাহকে সৌদি আরব ও অন্যান্য সুন্নি প্রধান দেশগুলোর কাছে চক্ষুশূল করেছে।

লেবাননের জনগণের মনোভাব

হেজবুল্লাহর প্রতি লেবাননের শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ লেবাননের শিয়ারা সংগঠনটিকে তাদের রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে দেখে। তবে, লেবাননের সুন্নি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে হেজবুল্লাহর প্রতি বিরূপ মনোভাব বিদ্যমান। তারা মনে করে যে, হেজবুল্লাহর অস্তিত্ব ও তাদের সামরিক ক্ষমতা লেবাননের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি স্বরূপ।

আরও পড়তে পারেন