অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

মুহাম্মদ ইউনূস ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের উত্থান: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব থেকে সমর্থনের সুর

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বৈঠকটি শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গঠনমূলক পদক্ষেপের একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। বৈঠকের পর হোয়াইট হাউজের বিবৃতিতে বাংলাদেশের নতুন সংস্কার কর্মসূচিতে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সমর্থনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন যুগের সূচনা বলে মনে করা হচ্ছে।

এই বৈঠকের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সহায়তা ঘোষণা করেছে, যা মূলত রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং তাদের আশ্রয়দানকারী স্থানীয় জনগণের কল্যাণে ব্যবহৃত হবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে বর্তমানে মি. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন, যেখানে তার সাথে শুধু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নয়, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, এবং আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার মতো আন্তর্জাতিক নেতাদের সাথে বৈঠক হয়েছে। পাশাপাশি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফসহ আরো বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনেতাদের সাথে মতবিনিময় হয়েছে।

এই গুরুত্বপূর্ণ সফরটি শুধু বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের নতুন অবস্থানকে আরো দৃঢ় করেছে, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ সংস্কার উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরো গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। বিশেষ করে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভে মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতি এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সাথে তার মঞ্চ ভাগাভাগি করার ঘটনা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিসরে আরো সুপরিচিত করেছে।

বাংলাদেশের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের সহযোগিতার বার্তা

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, মি. ইউনূসের জাতিসংঘে উপস্থিতির পর পশ্চিমা বিশ্বের নেতাদের উচ্ছ্বাস থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ একটি নতুন ও ইতিবাচক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের উপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে, যা গত কয়েক বছরে কিছুটা টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‍্যাবের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কিছুটা সংকটময় ছিল। ২০২৩ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনী ভিসা নীতি প্রণয়ন করেছিল, যা মূলত বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে শেখ হাসিনার সরকারকে চাপের মুখে ফেলে দিয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন এবং দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল।

এই উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে চায়, এমন বক্তব্য বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হয়েছিল। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এই দাবি বরাবরই অস্বীকার করেছে। তবুও চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে শুরু হওয়া কোটা বিরোধী আন্দোলন ক্রমে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়, যা শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পদত্যাগে বাধ্য করে।

অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে মুহাম্মদ ইউনূস: আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন। তখন থেকেই পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন তার প্রতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মি. ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা বরাবরই উঁচুতে ছিল, এবং তা এখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনায় কাজে লাগছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মি. ইউনূসের এই আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বাংলাদেশকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে এবং পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন মনে করেন, “আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অধ্যাপক ইউনূসের যে গ্রহণযোগ্যতা, তাতে এ ধরনের অভ্যর্থনাই তার জন্য স্বাভাবিক। প্রভাবশালী রাষ্ট্র নেতারা যেভাবে তাকে গ্রহণ করেছেন, তাতে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও বেড়েছে।”

এই বৈঠকগুলোতে র‍্যাবের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দেওয়া হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত।

বাংলাদেশের জন্য নতুন বার্তা: অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার

বিশ্লেষকরা বলছেন, মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার প্রধান হিসেবে পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন বাংলাদেশের সংস্কার উদ্যোগকে একটি নতুন দিগন্তে নিয়ে গেছে। এর ফলে বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব সংস্থার সহায়তা পেতে সক্ষম হবে, যা দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, “বাংলাদেশে যে একটি নতুন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বা দেশটি যে নতুন দিকে যাচ্ছে, সেই বার্তাই মুহাম্মদ ইউনূসের মাধ্যমে বাইরের পৃথিবীতে গেলো। তাকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রে যা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ নিয়ে ইতিবাচক বার্তা বিশ্ব পেয়েছে।”

মি. ইউনূস ইতিমধ্যেই নির্বাচনী কমিশন, বিচার বিভাগসহ ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ খাতের সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন কমিশন গঠন করেছেন। তিনি আশা করছেন, এই কমিশনগুলো অক্টোবর থেকে তাদের কার্যক্রম শুরু করবে এবং ডিসেম্বরের মধ্যে তার কাছে রিপোর্ট প্রদান করবে।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের জন্য বিশেষ সুযোগ

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বাংলাদেশের জন্য আর্থিক ও টেকনিক্যাল সহযোগিতার বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে বৈঠকটি বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কারণ এটি শুধু অর্থনৈতিক সহযোগিতাই নয়, বরং বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনের দিকনির্দেশনা দিয়েছে।

অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপক ইউনূস যে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছেন, সেটাই স্বাভাবিক। কারণ তার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা। এ কারণে পশ্চিমারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সংস্কারের ক্ষেত্রে পশ্চিমারা যে পাশে থাকবে, সেই শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য খুবই দরকার ছিল।”

এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পূর্ববর্তী সরকারের টানাপোড়েন কাটিয়ে ওঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের নাম এখন বৈশ্বিকভাবে ইতিবাচক আলোচনায় আসবে বলেই তিনি মনে করেন।

উপসংহার

মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নত করে বাংলাদেশের সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি নতুন ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠন করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

বিশ্লেষকরা আশা করছেন, মি. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে আরও দ্রুত অগ্রগতি হবে, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনে দেশটি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।

আরও পড়তে পারেন