শেখ হাসিনা
, ,

শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে বিতর্ক: দেশ ছাড়ার আগে কি তিনি পদত্যাগ করেছিলেন?

গত ৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর থেকেই তাঁর পদত্যাগ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ভারত যাওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনার কথিত ফোনালাপ এবং এক ‘পদত্যাগপত্র’ ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক আরও তীব্র হয়েছে। যদিও দলীয়ভাবে এই দাবিগুলোকে ভুয়া বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে, বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না।

বিতর্কের সূচনা: অডিও রেকর্ড ও পদত্যাগপত্র

সাম্প্রতিক সময়ে ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপ এবং পদত্যাগপত্রের ছবি ঘিরেই মূলত এই বিতর্ক নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে। এক অডিও রেকর্ডে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তিনি দেশ ছাড়ার আগে প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো পদত্যাগপত্র জমা দেননি বলেও উল্লেখ করেছেন। এই অডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পরই বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে।

পরদিনই একটি পদত্যাগপত্রের ছবি ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে শেখ হাসিনার স্বাক্ষর রয়েছে বলে দাবি করা হয়। সেই পদত্যাগপত্রে লেখা ছিল, “প্রাণহানি এড়ানোর জন্য আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” তবে, এই পদত্যাগপত্রকে আওয়ামী লীগ ভুয়া বলে দাবি করেছে। দলীয় ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়ে এই দাবিকে খণ্ডন করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদের বক্তব্য

শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরদিন তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ গণমাধ্যমে দাবি করেছিলেন, তাঁর মা আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেননি। তিনি বলেছিলেন, “মা কখনই আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেননি। বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে মিছিল নিয়ে যেতে শুরু করে, তখন মা সময় পাননি।” তাঁর মতে, শেখ হাসিনা তখনও সংবিধান অনুযায়ী দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সজীব ওয়াজেদের এই বক্তব্যের পরই শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়।

সেনাবাহিনী প্রধান ও রাষ্ট্রপতির বক্তব্য

শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেছিলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন।” একই দিনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনও তাঁর ভাষণে জানান, শেখ হাসিনা তাঁর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং তা গ্রহণ করা হয়েছে। এর পরপরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

পদত্যাগের নিয়মাবলী

বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৭ ধারা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে তা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিতে হবে। তবে, প্রশ্ন উঠছে, শেখ হাসিনা যদি আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ না করে থাকেন, তাহলে তাঁর পদ শূন্য ঘোষণা করা কতটা সংবিধান অনুযায়ী হয়েছে?

আইন বিশেষজ্ঞ কাজী জাহেদ ইকবালের মতে, “শেখ হাসিনা যদি আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ না করেন, তবে সংবিধানের ৫৭ ধারা অনুযায়ী তাঁর পদ শূন্য ঘোষণা করা আইনত বৈধ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।” তবে, তিনি আরও বলেন, “যেহেতু রাষ্ট্রপতি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন, তাই এ বিষয়ে কোনো সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা নেই।”

সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতামত

অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, গণঅভ্যুত্থানের সময় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগের প্রক্রিয়া নিয়ে এত জোরালোভাবে প্রশ্ন তোলার কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁদের মতে, একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়ার কারণে এমন সংকট তৈরি হয়েছে। তবে, যেহেতু নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, তাই এ নিয়ে আর কোনো আইনি বা সাংবিধানিক জটিলতা থাকবে না।

আইনজীবী জেড আই খান পান্নার মতে, “প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র দিয়েছেন কি দেননি, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকতে পারে না। কারণ রাষ্ট্রপতি এটি গ্রহণ করেছেন এবং সংসদ ভেঙে দিয়েছেন।”

ভবিষ্যতে সংকটের আশঙ্কা?

যদিও শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে বিতর্ক চলছে, অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন ভবিষ্যতে এ নিয়ে বড় ধরনের কোনো সংকটের আশঙ্কা কম। কারণ সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এবং তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ কম। তাছাড়া, গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতিতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া স্বাভাবিক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে, কিছু আইনজীবী মনে করেন, ভবিষ্যতে এ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন উঠলে নতুন করে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলছেন, “শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি নিয়ে সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা কম।”

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলেও রাজনৈতিকভাবে এটি কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ এবং নতুন সরকারের অধীনে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। তবে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই এই পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের অবস্থান জোরালোভাবে প্রকাশ করছে।

আওয়ামী লীগ বলছে, শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ না করলেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। অন্যদিকে, বিএনপি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চাইছে।

সংক্ষিপ্ত উপসংহার

শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং তাঁর পদত্যাগ নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা রাজনৈতিক মহল এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে এই বিতর্কের তাৎক্ষণিক কোনো সাংবিধানিক সংকট তৈরি না হলেও ভবিষ্যতে এটি নিয়ে আইনি জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

আরও পড়তে পারেন