সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু এই দুই পুরোনো মিত্রের মধ্যে মতবিরোধ ক্রমশ প্রকাশ্য হয়ে উঠছে। তৃণমূল থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে বিরোধের এই সুর স্পষ্ট।
অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচন আয়োজনের সময় দেওয়া নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দল দুটির মধ্যে সম্পর্কের ফাটল প্রথম প্রকাশ্যে আসে। এর আগে ২৫ বছরের রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে যেসব বিষয়ে তাদের মধ্যে ঐক্য ছিল, সেসব বিষয়েও হঠাৎ করে কেন এ ধরনের মতবিরোধ তৈরি হলো, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠছে।
প্রতিশোধ নেবার ইস্যুতে উত্তপ্ত বক্তব্য
গত সপ্তাহে জামায়াতে ইসলামী আমির ডা. শফিকুর রহমান একটি বক্তব্যে জানান, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নেওয়ার কথা। বিএনপির নেতারা এই বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। যদিও জামায়াতে ইসলামী সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার দাবি করেন, বিএনপির সাথে তাদের বোঝাপড়ায় কোনো সংকট নেই। তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “জামায়াত অন্য রাজনৈতিক দলের মতোই একটা দল। বিএনপির সাথে জামায়াতের বিরোধের প্রশ্ন আসবে কেন?”
এরপর ডা. শফিকুর রহমান তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, “প্রতিশোধ না নেয়ার মানে হচ্ছে আমরা আইন হাতে তুলে নেবো না। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অপরাধ যিনি করেছেন তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। শাস্তিও হতে হবে।” এই বক্তব্যের পরই বিএনপির মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।
ভারতের সাথে সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক
গত ২৮শে অগাস্ট ঢাকায় সাংবাদিকদের সাথে আলাদা এক অনুষ্ঠানে কথা বলতে গিয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “আমরা সবার সাথে বন্ধুত্ব চাই। প্রতিবেশী বদলানো যায় না। আপনারা বদলানোর চিন্তা করেন কেন।” এ বক্তব্যও বিএনপির মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, “গত কয়েকদিনে দেখেছি কিছু রাজনৈতিক দল একটি প্রতিবেশী দেশের ফাঁদে পা দিয়েছে।”
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীও এ বিষয়ে জামায়াতের বক্তব্যের জবাব দিতে দেখা যায়।
নির্বাচন ইস্যুতে বিপরীতমুখী অবস্থান
বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে নির্বাচন ইস্যুতেও বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। গত ৮ই অগাস্ট দায়িত্ব নেয়ার পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেই ভাষণে জাতীয় নির্বাচন কবে হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি, যা নিয়ে বিএনপি অসন্তোষ প্রকাশ করে।
অন্যদিকে, জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “এই সময়ে কেউ নির্বাচন নির্বাচন জিকির তুললে জাতি তা গ্রহণ করবে না।” জামায়াতের এই অবস্থান বিএনপির জন্য ছিল অপ্রত্যাশিত।
প্রশাসনিক পদ নিয়ে দূরত্ব
বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের সরিয়ে দেওয়ার পর নিজস্ব লোকের পদায়ন নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে নীরব মনোমালিন্য চলছে।
বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ নিয়ে গত মাসে জটিলতা দেখা দেয়। বিএনপি সমর্থিত অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলামকে নিয়োগের সম্ভাবনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত জামায়াতের সমর্থিত অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
ইসলামী দল নিয়ে ঐক্য প্রসঙ্গ
শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার পর ইসলামী দলগুলো নিয়ে বৃহত্তর জোট গঠনের উদ্যোগ নিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে কওমি মাদরাসাভিত্তিক ইসলামী দলের সাথে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ভবিষ্যতের রাজনীতির প্রেক্ষাপট
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে চলমান এই দূরত্ব দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে নতুন সমীকরণ তৈরি হতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী কীভাবে তাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করে এগিয়ে যাবে, তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।