মুহাম্মদ ইউনূস, বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র দু’দিন আগে ভারতীয় চ্যানেল এনডিটিভিতে একটি সাক্ষাৎকার দেন। এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আপনি যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলেন, তাহলে সেই অস্থিরতার আঁচ কিন্তু বাংলাদেশের বাইরেও মিয়ানমার, সেভেন সিস্টার্স, পশ্চিমবঙ্গ – সর্বত্রই অগ্ন্যুৎপাতের মতো ছড়িয়ে পড়বে।” এই বক্তব্যে তিনি সেভেন সিস্টার্সের গুরুত্বকে তুলে ধরেন, যা ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
‘সেভেন সিস্টার্স’ শব্দবন্ধটির ব্যবহার এবং তার প্রাসঙ্গিকতা
ভারতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে বোঝাতে এখন সাধারণত ‘নর্থ-ইস্ট’ বা ‘নর্থ-ইস্টার্ন স্টেটস’ শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়। ‘সেভেন সিস্টার্স’ শব্দটি, যা এককালে প্রচলিত ছিল, এখন ভারতের মানুষ প্রায় ভুলতেই বসেছেন। তবে বাংলাদেশে উত্তর-পূর্ব ভারতের অঞ্চলটিকে বোঝাতে এখনও ‘সেভেন সিস্টার্স’ শব্দবন্ধটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যার পর একজন ছাত্রকে স্লোগান দিতে শোনা গিয়েছিল, “বন্যায় যদি মানুষ মরে, সেভেন সিস্টার্স থাকবে না রে!”। সেই ভিডিও দ্রুত ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতেও। এ থেকেই বোঝা যায়, সেভেন সিস্টার্সের সাথে বাংলাদেশের যে একটি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে, তার একটি ইঙ্গিতই হয়তো প্রচ্ছন্ন ছিল সেই স্লোগানে।
সেভেন সিস্টার্সের ভৌগোলিক অবস্থান ও ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রেক্ষাপট
ভারতের মানচিত্রে সেভেন সিস্টার্সের উৎপত্তি এবং নামকরণ হয়েছিল ১৯৭১ সালে ভারতের পার্লামেন্টে পাস হওয়া ‘নর্থ ইস্টার্ন কাউন্সিল অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে। এর অধীনে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে উন্নয়নের জন্য একটি পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এই রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলো হল – আসাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম।
এই সাতটি রাজ্যকে একত্রে ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে অভিহিত করা হয়, যা সময়ের সাথে সাথে সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়ে যায়। নতুন রাজ্য হিসেবে ত্রিপুরার আত্মপ্রকাশের দিন টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিক জ্যোতি প্রসাদ শইকিয়া তার পাঠানো এক রিপোর্টে এই শব্দবন্ধটি প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেন। তিনি পরবর্তীতে ‘ল্যান্ড অব সেভেন সিস্টার্স’ নামে একটি বইও লেখেন, যা আরও বেশি জনপ্রিয়তা পায়।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এবং সেভেন সিস্টার্সের ভৌগোলিক গুরুত্ব
বাংলাদেশের সাথে ভারতের প্রায় ৪০০০ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ স্থল-সীমান্ত রয়েছে, যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই সেভেন সিস্টার্সের সাথেই সংযুক্ত। এই সাত রাজ্যের মধ্যে চারটি – আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম বাংলাদেশের সাথে সরাসরি সীমান্ত ভাগাভাগি করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সেভেন সিস্টার্সের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী অতীতে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সেভেন সিস্টার্সের সবচেয়ে বড় রাজ্য আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা প্রকাশ্যেই বলেছেন, বাংলাদেশ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আলফা-র নেতাদের ভারতের হাতে হস্তান্তর করেছে বলেই আসাম আজ এত ‘শান্তিপূর্ণ’, এবং রাজ্যের মানুষ ‘রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন’। সেভেন সিস্টার্সের স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের ভূমিকায় ভারতের কর্তৃপক্ষরা কৃতজ্ঞ।
সেভেন সিস্টার্সের রাজনৈতিক ও সামরিক গুরুত্ব
সেভেন সিস্টার্সের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারতের জন্য কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। শিলিগুড়ি করিডর বা ‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত এই অঞ্চলটি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সংযোগ ঘটায়। এই করিডরের সবচেয়ে সরু অংশটা মাত্র ২১ কিলোমিটার চওড়া, যা নিরাপত্তার দৃষ্টিতে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে একটি ‘ভালনারেবল’ বা বিপজ্জনক অবস্থানে রেখেছে।
ভারতের সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা এই করিডরের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে, তবে এই অঞ্চলের সাথে দেশের বাকি অংশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগ স্থাপন করা এখনও পুরোপুরি সম্ভব হয়নি।
সেভেন সিস্টার্সের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা
সেভেন সিস্টার্সের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হয়েছে। নাগাল্যান্ড, মণিপুর, আসাম, মিজোরাম এবং ত্রিপুরায় এসব আন্দোলনের পিছনে প্রধানত জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাত এবং বিভিন্ন দাবির জন্য সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা গিয়েছে। সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে তারা নিজেদের অধিকার ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছে, যা ভারতীয় রাজনীতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
সেভেন সিস্টার্সের একটি বিস্তীর্ণ অংশে দীর্ঘদিন ধরে সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখতে হয়েছে এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন (‘আফস্পা’) বলবৎ রাখা হয়েছে। এইসব অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ও সেভেন সিস্টার্সের সম্পর্কের ভূমিকা
সেভেন সিস্টার্সের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হল বাংলাদেশের সাথে তাদের সম্পর্ক। বাংলাদেশের ভূখণ্ডের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা সেভেন সিস্টার্সের শান্তি এবং স্থিতিশীলতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। অতীতে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় পেয়েছিল, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন বাংলাদেশ সরকার এসব গোষ্ঠীর অস্তিত্ব স্বীকার না করলেও শেখ হাসিনার সরকার সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে এবং এসব গোষ্ঠীর নেতাদের ভারতের হাতে তুলে দিতে শুরু করে। এই পদক্ষেপ ভারতের নিরাপত্তার জন্য একটি বড় সফলতা হিসেবে বিবেচিত হয়।
উপসংহার
সেভেন সিস্টার্সের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং তাদের ভূগোল, রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা এবং শান্তি বজায় রাখতে পারস্পরিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের সরকার, সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা এবং সমন্বয় প্রয়োজন। সেভেন সিস্টার্সের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং তাদের প্রতিরোধে বাংলাদেশের ভূমিকাও প্রশংসিত হচ্ছে।
এই সম্পর্ককে আরও উন্নত করতে হলে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা এবং পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে, যাতে উভয় দেশের জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত হয়।
Leave a Reply