বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কার্যক্রম নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
পররাষ্ট্রসচিব মো. জসিম উদ্দিন গতকাল ভারতের হাইকমিশনার প্রশান্ত ভার্মাকে ডেকে জানিয়েছেন, “উপযুক্ত অনুমোদন ছাড়া বিএসএফ-এর এই উদ্যোগ দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং সহযোগিতার মনোভাবকে ক্ষুণ্ণ করছে।”
বিএসএফ-এর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে দু’দেশের সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দেওয়ার প্রেক্ষিতে এই আলোচনার আয়োজন করা হয়।
সীমান্তে বেড়া নির্মাণ নিয়ে বিরোধ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সীমান্তে বেড়া নির্মাণের উদ্যোগের কারণে পাঁচটি সীমান্ত এলাকায় উল্লেখযোগ্য উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
এই এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, লালমনিরহাট এবং টিনবিঘা করিডোর।
পররাষ্ট্রসচিব বলেছেন, বিএসএফ-এর বেড়া নির্মাণ কার্যক্রম ছাড়া তাদের অন্যান্য অপারেশনাল কর্মকাণ্ডও সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
বিজিবি ও স্থানীয় জনগণের তৎপরতায় বিএসএফ বাধ্য হয়েছে তাদের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করতে।
গৃহায়ণ বিষয়ক উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, ৪,১৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের মধ্যে ভারত ইতোমধ্যে ৩,২৭১ কিলোমিটার অংশে বেড়া দিয়েছে।
অবশিষ্ট প্রায় ৮৮৫ কিলোমিটার অংশ এখনো বেড়াহীন।
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের পূর্ববর্তী সরকার কয়েকটি অসম চুক্তি সই করেছিল, যার ফলেই এখন এই উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।”
অসম চুক্তি ও সীমান্ত বিরোধের ইতিহাস
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে কিছু এনক্লেভ এবং বিরোধপূর্ণ জমি বিনিময় করা হয়েছিল।
এরপর ১৯৭৫ সালে যৌথ সীমান্ত নির্দেশিকা এবং ২০১১ সালে স্থলসীমান্ত চুক্তির প্রটোকল সই হয়।
তবে এসব চুক্তির কিছু শর্ত নিয়ে বিরোধ রয়েছে।
১৯৭৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী, সীমান্ত থেকে ১৫০ গজের মধ্যে কোনও প্রতিরক্ষা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা যাবে না।
যেকোনো নির্মাণকাজের জন্য দুই দেশের সম্মতি প্রয়োজন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০১০ সালের একটি চুক্তির ভিত্তিতে টিনবিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
কিন্তু এই চুক্তি ভারতকে অঙ্গারপোতা এলাকায় সীমান্তে বেড়া নির্মাণের অনুমতি দেয়, যা বাংলাদেশকে বর্তমানে সমস্যায় ফেলছে।
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, “এসব চুক্তি নিয়ে এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এগুলো সই না হলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত।”
সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ
বিএসএফ-এর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সুনামগঞ্জ সীমান্তে এক বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যার ঘটনা।
পররাষ্ট্রসচিব জসিম উদ্দিন এই ঘটনায় ভারতের প্রতি গভীর হতাশা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, বিএসএফ দীর্ঘদিন ধরে নন-লিথাল অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিলেও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড থামছে না।
বাংলাদেশ ভারতকে এ বিষয়ে তদন্ত চালানোর আহ্বান জানিয়েছে।
সেই সঙ্গে দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।
আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আশা
বিজিবি-বিএসএফ-এর মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এই বৈঠকে সীমান্ত উত্তেজনা এবং বেড়া নির্মাণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রসচিব।
ভারতের হাইকমিশনার প্রশান্ত ভার্মা সাংবাদিকদের জানান, সীমান্তে অপরাধ দমন এবং শান্তি বজায় রাখতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি বলেন, “বিএসএফ ও বিজিবি একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করছে। আমরা বিশ্বাস করি, এই সমঝোতা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সীমান্তে অপরাধ দমন সম্ভব হবে।”
ভারতের পক্ষ থেকে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকে অপরাধ দমন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই সমস্যাগুলো দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এবং বিদ্যমান চুক্তির আলোকে সমাধান করা উচিত।