তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণ খাতে দীর্ঘদিন ধরে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে আসছে।
গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বারবার ঘুস দিয়ে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও তমা কনস্ট্রাকশনের প্রভাব কমেনি, বরং আগের মতোই সক্রিয় রয়েছে।
সর্বশেষ ৪ ডিসেম্বর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে সুনামগঞ্জে ৫৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়।
৪২৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ পেয়েছে তমা কনস্ট্রাকশন।
এই প্রকল্প হাতে নেওয়ার মধ্য দিয়ে তমা পুনরায় প্রমাণ করেছে যে, সরকারের ক্ষমতা বদলালেও তাদের অবস্থান অটুট রয়েছে।
ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার: রেল ও সড়ক খাতে আধিপত্য
তমার মতোই আরেকটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হলো ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।
দেশের রেলওয়ে ও সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ খাতে এই কোম্পানির একচেটিয়া প্রভাব দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
সূত্র জানায়, এ ধরণের প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে ঘুস লেনদেনের মাধ্যমে বড় বড় প্রকল্প বাগিয়ে নিচ্ছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দুর্নীতিতে সাময়িক ভাটা পড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দু: অভিজাত ক্লাব ও পাঁচ তারকা হোটেল
দেশে বড় অংকের ঘুসের লেনদেন ও দেনদরবারের জন্য অভিজাত ক্লাব এবং পাঁচ তারকা হোটেলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এসব জায়গায় কিছুদিনের জন্য স্থবিরতা নেমে এলেও এখন আবার সরগরম হয়ে উঠেছে।
পালিয়ে যাওয়া অনেক রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ী এই ক্লাব ও হোটেলগুলোর মাধ্যমে তাদের প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করছেন।
বিশেষত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং নারায়ণগঞ্জের নেতা শামীম ওসমানের মতো ব্যক্তিরা বিদেশে থাকা সত্ত্বেও দেশে তাদের আর্থিক বিনিয়োগ বজায় রেখেছেন।
শামীম ওসমান সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিলাসবহুল জীবনযাপন করলেও বাংলাদেশের করপোরেট গ্রুপে তার বিনিয়োগ অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে।
ব্যাংক খাতে লুটপাট: শেখ হাসিনা যুগের উত্তরাধিকার
শেখ হাসিনা সরকারের সময় ব্যাংক খাত দুর্নীতির প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তন ও লুটপাট হয়েছে রাজনৈতিক ও করপোরেট যোগসাজশের মাধ্যমে।
৫ আগস্টের পর নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নিয়ে কিছু পদক্ষেপ নিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেতরের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, কিছু চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হলেও ঘুস নেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা এখনো তাদের অবস্থানে রয়ে গেছেন।
এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংক খাতে কোনো প্রকৃত স্থিতিশীলতা ফিরবে না বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনীতিতে দুর্নীতির ধারা অব্যাহত
দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কার প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ৫ আগস্টের পরিবর্তন সত্ত্বেও দখলদার ও চাঁদাবাজির ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
নেতৃত্বের পরিবর্তন হলেও রাজনৈতিক ও করপোরেট সংস্কৃতির মধ্যে কোনো আমূল পরিবর্তন দেখা যায়নি।
তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনায় যে নৈতিকতার শিক্ষা আশা করা হয়েছিল, তা বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি।
নতুন সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এই অপতৎপরতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করবে।
অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে হলে সুশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে দুর্নীতির এই চক্র ভাঙতে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সরকার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে।