বাংলাদেশের পোশাক শিল্প, যা দেশটির বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস, বর্তমানে গভীর সংকটে রয়েছে। চলতি বছরে কয়েক ডজন কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং লাখো শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়ার পাশাপাশি, অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
রপ্তানিতে পতন: প্রতিযোগী দেশগুলোর অগ্রগতি
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৩.৩৩ শতাংশ কমেছে। এর বিপরীতে ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
ভারতের পোশাক রপ্তানি গত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবণতায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রয়াদেশ সরিয়ে নেওয়ায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের পোশাক খাতকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে কৌশলগত পরিবর্তন আনতে হবে।
কারখানা বন্ধ ও শ্রমিক ছাঁটাই
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, এক বছরে তাদের সদস্যভুক্ত ৭৬টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে চাকরি হারিয়েছেন ৫১ হাজার শ্রমিক।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) জানিয়েছে, নিট পোশাক খাতে ৫০টিরও বেশি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে ৩৫ হাজারের বেশি শ্রমিক বেকার হয়েছেন।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) জানিয়েছে, তাদের ১৪টি বৃহৎ কারখানা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এসব কারখানায় কর্মরত আট হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন।
বেক্সিমকো গ্রুপ তাদের ১৫টি কারখানা বন্ধ করে ৪০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করেছে। প্রতিষ্ঠানটি কার্যাদেশের অভাবের কারণ দেখালেও শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, অর্ডার থাকা সত্ত্বেও কারখানা বন্ধ করা হয়েছে।
উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও অন্যান্য সংকট
উৎপাদন ব্যয়ের অতিরিক্ত চাপ, গ্যাস সংকট, উচ্চ সুদহার এবং এলসি সংক্রান্ত জটিলতা অনেক কারখানার জন্য টিকে থাকা কঠিন করে তুলেছে।
বিজিএমইএর সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, অস্থিরতার কারণে প্রায় ৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ কমে গেছে। আগে ক্রেতারা বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকলেও এখন তারা অন্য দেশে অর্ডার দিচ্ছেন।
মিথিলা অ্যাপারেলসের চেয়ারম্যান আযহার খান বলেন, “নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ না পেলে টিকে থাকা সম্ভব নয়। এলপি গ্যাস দিয়ে উৎপাদন চালালে ব্যয় আরও বেড়ে যায়।”
শ্রমিকদের মানবিক বিপর্যয়
কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রভাব শুধু অর্থনৈতিক নয়, মানবিক দিক থেকেও গভীর। চাকরি হারানো শ্রমিকরা বাড়িভাড়া দিতে পারেন না, পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খান।
একজন শ্রমিক তানজিনা বেগম বলেন, “কারখানা বন্ধ হওয়ায় পাঁচ সদস্যের পরিবারের তিন বেলা খাবার বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়ের লেখাপড়াও বন্ধ হওয়ার পথে।”
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেছেন, “বেকার শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ জরুরি।”
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক দূর করতে ভয়ভীতিহীন কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হবে।”
সংকট সমাধানে করণীয়
বিজিএমইএর নেতারা মনে করছেন, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে এবং সমাধানের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি টাস্কফোর্স গঠন প্রয়োজন।
শ্রম সংস্কার এবং শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষার পাশাপাশি, দেশের পোশাক খাতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেছেন, “ইউনিয়ন চর্চার পরিবেশ তৈরি, দর-কষাকষির সুযোগ বৃদ্ধি এবং সুষ্ঠু শ্রম সংস্কার না হলে আজকের সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।”