বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে তীব্র ডলার সংকটে ভুগছে।
রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে ইতিবাচক ধারা থাকলেও ডলারের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে ব্যাংকিং খাত চাপের মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অতীত নীতির ব্যর্থতা এবং ক্রলিং পেগ পদ্ধতির অকার্যকারিতার কারণে সংকট আরো গভীর হয়েছে।
রিজার্ভে টান, ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি
২০২৪ সালের নভেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর নস্ট্র অ্যাকাউন্টে ডলার স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩৮ কোটি ডলারে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এই স্থিতি ২৮.১৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
এ অবস্থায় আমদানি দায় মেটাতে এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের একটি অভ্যন্তরীণ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাজারে ডলারের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় হার ১২০ টাকা নির্ধারণ করলেও এই দরে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।
চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের দর ১২৯ টাকায় পৌঁছেছে।
তিন বছরে রিজার্ভে ব্যাপক ক্ষয়
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির প্রক্রিয়া গত জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
এই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করেছে।
এরপরও ডলারের বাজার স্থিতিশীল হয়নি।
২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে এই রিজার্ভ কমে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ২০.১৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
চলতি মাসের শুরু থেকে বাজার থেকে ডলার কিনে রিজার্ভ কিছুটা বাড়ানো হয়েছে।
ডিসেম্বরে দেড় বিলিয়ন ডলার যোগ হলেও সংকট কাটেনি।
ক্রলিং পেগ নীতির ব্যর্থতা
২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল করতে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করে।
এই পদ্ধতির আওতায় ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর সম্পূর্ণ ছেড়ে না দিয়ে ধীরে ধীরে সামঞ্জস্য করা হয়।
ডলারের দর ১১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৮ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।
তবে এই নীতি ডলার সংকট সমাধানে কার্যকর প্রমাণিত হয়নি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ক্রলিং পেগ পদ্ধতি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সময় কার্যকর হতে পারে।
বিনিময় হারে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ হুন্ডির বাজারকে শক্তিশালী করেছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে সংকট এতদূর বাড়ত না।
হুন্ডির বিস্তার ও নীতিগত ব্যর্থতা
নানা পরীক্ষামূলক নীতির সুযোগে দেশে হুন্ডির বাজার আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে।
অনেক ব্যবসায়ী বৈধ আমদানি দেখিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠাচ্ছেন।
উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশে টিউশন ফি পরিশোধের মতো বৈধ লেনদেনও এখন হুন্ডির মাধ্যমে হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০২২ সালে বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে রিজার্ভ ক্ষয়ে যেত না।
তাদের মতে, অতীতের ভুল নীতি এবং রিজার্ভের অপব্যবহারের কারণে দেশের অর্থনীতি চাপে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. মো. হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, ক্রলিং পেগ নীতি থেকে সরে আসার বিকল্প ভাবা হচ্ছে।
তবে এখন পর্যন্ত নতুন কোনো নীতি নির্ধারণ করা হয়নি।
সংকটের সম্ভাব্য সমাধান
বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং আইএমএফের কাছ থেকে ২-৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা পাওয়া গেলে সংকট কিছুটা কমবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে সাময়িক চাপে পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে।
ডলার সংকটের ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে।
এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় দিন দিন বাড়ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি সংকটময় অবস্থায় রয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে কার্যকর নীতি গ্রহণের মাধ্যমে ডলার সংকট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।