মিয়ানমার সংকট নিয়ে ছয়টি দেশ থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বৈঠকে বসতে চলেছে।
বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার এই বৈঠক দুইটি ধাপে অনুষ্ঠিত হবে বলে নিশ্চিত করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
প্রথম বৈঠকে অংশ নেবে মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত, চীন, লাওস এবং থাইল্যান্ড।
দ্বিতীয় বৈঠকে আসিয়ান (অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনস)-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও অংশ নেবেন।
তবে, এই বৈঠকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়।
মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছেছে।
বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জান্তা সরকারের সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সীমান্ত অঞ্চলগুলো।
বিশেষত রাখাইন রাজ্যের বিশাল অংশ বিদ্রোহী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
রাখাইনের এই বাস্তবতায় মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই বৈঠক সংকট সমাধানের প্রথম ধাপ হতে পারে।
বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ও লক্ষ্য
বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমার ইস্যু বরাবরই একটি জটিল ও স্পর্শকাতর সমস্যা।
বিশেষত রোহিঙ্গা সংকট এবং সীমান্ত নিরাপত্তা বাংলাদেশের প্রধান উদ্বেগের কারণ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে তিনটি মূল বিষয় আলোচনা হবে।
বিষয়গুলো হলো সীমান্ত পরিস্থিতি, সীমান্ত অপরাধ এবং মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানান, আলোচনার অগ্রগতি অনুযায়ী বাংলাদেশ তার অবস্থান তুলে ধরবে।
সরকারের একমাত্র লক্ষ্য হলো মিয়ানমারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন।
রাখাইনের আরাকান আর্মির ক্রমবর্ধমান প্রভাব বাংলাদেশকে নতুন কৌশল নির্ধারণে বাধ্য করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বৈঠক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে।
ভারত-চীনের ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ
রাখাইন রাজ্যে ভারত এবং চীনের স্বার্থ একে অপরের বিপরীতে অবস্থান করছে।
ভারত রাখাইন দিয়ে কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যা তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই প্রকল্পে কলকাতা থেকে মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দর হয়ে মিজোরাম পর্যন্ত নৌ ও সড়ক যোগাযোগ তৈরি করা হচ্ছে।
কিন্তু রাখাইনের যে অঞ্চল দিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, তার বেশিরভাগই এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।
আরাকান আর্মির ওপর চীনের প্রভাব রয়েছে, যা ভারতের স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের প্রভাবের কারণে ভারতকে আরাকান আর্মির সঙ্গে সরাসরি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
অন্যদিকে, রাখাইনে চীনের বিনিয়োগ এবং কৌশলগত স্বার্থ অনেক বেশি গভীর।
চীন রাখাইনে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং সমুদ্রবন্দর প্রকল্পে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছে।
রাখাইনের চকপিউ (কিয়কফিউ) বন্দরের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সরাসরি চীনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে চীন।
এই অঞ্চলের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ভারত ও চীনের মধ্যে ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনকে আরও তীব্র করেছে।
আরাকান আর্মি: নতুন বাস্তবতা ও বাংলাদেশের সম্ভাব্য কৌশল
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ধীরে ধীরে একটি প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী পুরো রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।
শুধু সিতওয়ে, যা রাজ্যের রাজধানী, সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আরাকান আর্মি সম্ভবত মিয়ানমারের প্রথম বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যারা পুরো একটি রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে চলেছে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আরাকান আর্মি এখন বাস্তবতার একটি অংশ হয়ে উঠেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।
তবে এটি এখনো নিশ্চিত নয় যে বাংলাদেশ সরকার তাদের সঙ্গে সরাসরি কোনো আলোচনা শুরু করেছে কিনা।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা খলিলুর রহমান সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেছেন, সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ প্রয়োজন হতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকটের কারণে এই কৌশল বাংলাদেশকে একাধিক দিক থেকে সুযোগ এনে দিতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নতুনভাবে ভাবার সুযোগ দিচ্ছে।
আসিয়ানের ভূমিকায় বাংলাদেশের প্রত্যাশা
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে আসিয়ান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন কূটনৈতিকরা।
থাইল্যান্ডে আয়োজিত বৈঠকটি আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদারের একটি সুযোগ।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ এই বৈঠকের মাধ্যমে আসিয়ানের সমর্থন পেতে কাজ করতে পারে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে আসিয়ান।
তবে, এখন পর্যন্ত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞ বায়েজিদ সরোয়ার মনে করেন, আসিয়ানের মাধ্যমে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে পারবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আসিয়ানে বাংলাদেশের সম্পৃক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় এই বৈঠক সহায়ক হতে পারে।
অন্যদিকে, আসিয়ান দেশগুলো বাংলাদেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সুযোগ তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশের লক্ষ্য: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা
বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমার ইস্যুর কেন্দ্রে রয়েছে রোহিঙ্গা সংকট।
সরকারের মূল লক্ষ্য হলো মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি রাখাইন রাজ্যে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন।
তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, ব্যাংককের বৈঠকে সীমান্ত নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে।
রাখাইনে আরাকান আর্মির ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশকে এখন মিয়ানমারের সরকার ও আরাকান আর্মির সঙ্গে দ্বিমুখী কৌশল নিয়ে এগোতে হবে।
এই কৌশল বাংলাদেশকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করবে।
বৈঠক থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সমর্থন বাংলাদেশের কৌশলকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।