নগদ লিমিটেডে অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক অর্থ বা ই-মানি তৈরি এবং ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট দেখিয়ে বড় ধরনের আর্থিক জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে।
ফরেনসিক পরিদর্শনে উঠে এসেছে, ৬৪৫ কোটি টাকার অতিরিক্ত ই-মানি ইস্যু করা হয়েছে যা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রকৃত টাকার সমান নয়।
২০১৭ সালে চুক্তি অনুযায়ী, ব্যাংকে জমা থাকা টাকার সমপরিমাণ ই-মানি ইস্যু করার নিয়ম থাকলেও নগদ তা লঙ্ঘন করেছে।
এ ছাড়া, ৪১টি অনুমোদনহীন পরিবেশক হিসাব তৈরি করে ১,৭১১ কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে।
এসব পরিবেশক হিসাব থেকে মূলত সরকারি ভাতা বিতরণ করা হতো।
প্রশাসক দলের মতে, এসব ভুয়া পরিবেশক নিয়োগ দিয়েই এই বড় মাপের জালিয়াতি সম্ভব হয়েছে।
ভাতাভোগীদের অনেকের টাকা তিন দিনের মধ্যে তোলা না হলে তা নিজেরা তুলে নেওয়া হতো বলে অভিযোগ উঠেছে।
নথিপত্রে দেখা গেছে, কুমিল্লার পরিবেশক রংপুরের ভাতাভোগীদের অর্থ বিতরণ করেছে, যা অসঙ্গতির প্রমাণ।
নগদের আর্থিক অনিয়মকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা ‘দেশের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল জালিয়াতি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
প্রশাসক নিয়োগ পাওয়ার পর তদন্তে এই চিত্র প্রকাশ্যে আসে।
ডাক বিভাগের ওপর দায়
নগদের সঙ্গে সরকারি ডাক অধিদপ্তরের চুক্তি থাকায় এর আর্থিক দায়ও ডাক বিভাগের ওপর পড়ছে।
ডাক অধিদপ্তর ২০১৯ সালে নগদকে মোবাইলে আর্থিক সেবা দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিল।
চুক্তি অনুযায়ী, নগদ ও ডাক অধিদপ্তর লাভ-ক্ষতির অংশীদার হলেও চুক্তির শর্ত সঠিকভাবে মানা হয়নি।
ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, ক্ষতিপূরণ আদায়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
ফরেনসিক তদন্তে দেখা গেছে, নগদ পরিচালনার সময় চুক্তির নিয়মাবলি সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়নি।
এর ফলে, সরকারি ভাতা বিতরণে ব্যবহৃত টাকার একটি বড় অংশ জালিয়াতির মাধ্যমে লোপাট হয়েছে।
প্রশাসক দল মনে করে, ডাক অধিদপ্তর এসব আর্থিক অনিয়মের আইনি সমাধানে এগিয়ে না এলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
ডাক বিভাগের অনুমতি ছাড়াই অতিরিক্ত ই-মানি ইস্যু এবং ভুয়া পরিবেশক নিয়োগ নগদের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ করেছে।
সরকারি ভাতা বিতরণে একক নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ নগদ ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ডাক বিভাগের ঘাড়ে এই আর্থিক দায় বর্তানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তদন্ত ও শাস্তি
অতিরিক্ত ই-মানি ইস্যু ও অনুমোদনহীন পরিবেশক তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছয় কর্মকর্তার নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে।
নগদ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, এবং প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তাসহ ছয়জনকে আইনি জবাবদিহির আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে।
ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দিয়ে এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
এই ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম এবং চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।
নগদের প্রশাসক মুহম্মদ বদিউজ্জামান দিদার বলেছেন, এই অনিয়মের জন্য চুক্তিবদ্ধ পক্ষ হিসেবে ডাক বিভাগ আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে।
তদন্তে উঠে এসেছে, অতিরিক্ত ই-মানি ইস্যু করে পরিচালন খরচ মেটানো হয়েছে এবং কিছু ব্যাংকঋণ সমন্বয় করা হয়েছে।
অতিরিক্ত ই-মানি তৈরি বন্ধ করে প্রশাসক দল এখন আগের অনিয়ম ধরে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে নগদের সাবেক সিইও তানভীর আহমেদ এবং জুনিয়র চেম্বারের দুই প্রভাবশালী নেতা রয়েছেন।
অভিযুক্তদের অনেকে নগদ লিমিটেডের মালিকানার অংশীদার, যা তদন্তের বিষয়টিকে আরও জটিল করেছে।
রাজনৈতিক প্রভাব
নগদের মালিকানায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য এবং রাজনৈতিক নেতাদের সংশ্লিষ্টতা উঠে এসেছে।
নগদ লিমিটেডের শুরুর দিকের মালিকানায় নাহিম রাজ্জাক এবং রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের মতো প্রভাবশালী নেতারা ছিলেন।
তৎকালীন সরকার নগদকে সরকারি ভাতা বিতরণের একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেছে নেওয়ায় এর সাফল্য দ্রুত বাড়ে।
নগদ কার্যক্রম শুরু করার পর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার সুবিধা নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরকারি ভাতা বিতরণে নিয়োজিত থাকায় নগদ জালিয়াতি করার সুযোগ পেয়েছে।
প্রশাসক দলের মতে, নগদের পেছনে থাকা রাজনৈতিক প্রভাবই এর অবৈধ কার্যক্রমকে আড়াল করেছে।
তথ্য অনুসারে, নগদের মালিকানায় থাকা প্রভাবশালী নেতাদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি সুবিধা পেয়েছে।
ফরেনসিক তদন্তে এই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আরও গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হবে।
শুরুর গলদ: নগদের প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা
নগদের প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই ছিল কাঠামোগত ত্রুটি, যা পরবর্তী অনিয়মের পথ খুলে দেয়।
২০১৭ সালে ডাক অধিদপ্তর পোস্টাল ক্যাশ কার্ড চালুর জন্য দরপত্র আহ্বান করে, যেখানে ডিজিটাল আর্থিক সেবার বিষয়টিও যোগ করা হয়।
ডাক অধিদপ্তরের সঙ্গে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির চুক্তি অনুযায়ী, সেবার আয় থেকে ৫১ শতাংশ ডাক অধিদপ্তর এবং ৪৯ শতাংশ থার্ড ওয়েভ পাবে।
২০১৯ সালে ‘নগদ’ নামে সেবাটি চালু হলেও এটি ব্যাংক হিসাব বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ অনুমোদন পায়নি।
শর্ত মানা ছাড়াই মোবাইলে আর্থিক সেবা শুরু করায় নগদ শুরু থেকেই অনিয়মের আশ্রয় নেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২০ সালে সাময়িক অনুমতি দিলেও পরে সেবাটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ডিজিটাল ব্যাংক হিসেবে অনুমোদন পায়নি।
নগদের পরিচালনা থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি থেকে নগদ লিমিটেডে স্থানান্তরিত হয়, তবে এই নাম পরিবর্তন প্রক্রিয়া ছিল অস্বচ্ছ।
নগদ দ্রুতই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে, যার গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৯ কোটি।
অবৈধভাবে অনুমোদিত পরিবেশক ও এজেন্ট নিয়োগ এবং সরকারি ভাতা বিতরণের সুযোগ নগদের অস্বাভাবিক সাফল্যের পেছনে ছিল।
সরকারি বিধি লঙ্ঘন করে সহজেই হিসাব খোলার সুযোগ নগদের জনপ্রিয়তা বাড়ালেও তা ভবিষ্যৎ জালিয়াতির ভিত্তি তৈরি করে।
মালিকানা ও রাজনৈতিক প্রভাব
নগদের প্রতিষ্ঠাকালীন মালিকানায় থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির সঙ্গে কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা ছিল।
২০১৮ সালে থার্ড ওয়েভের শেয়ার ছেড়ে দিয়ে এতে যুক্ত হন আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুল।
এছাড়া, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিবের স্ত্রী রেজওয়ানা নূরও একসময় নগদের শেয়ারহোল্ডার ছিলেন।
পরবর্তী সময়ে নগদের পরিচালনায় রাজনৈতিক নেতাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমে অস্বচ্ছতা ও অনিয়মের সুযোগ সৃষ্টি করে।
নগদ সরকারি ভাতা বিতরণের একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ায় এর আর্থিক ক্ষমতা এবং জালিয়াতির ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
নগদের শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে যুবলীগের একজন কেন্দ্রীয় সদস্যও রয়েছেন, যা প্রতিষ্ঠানটির রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ।
অনেকেই মনে করেন, এই রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই নগদ এত দ্রুত শর্তহীন অনুমোদন এবং পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকও প্রভাবশালী মালিকানার চাপে নগদের অনিয়মে পর্যাপ্ত নজরদারি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সরকারি ভাতার অর্থ লোপাট
সরকারি ভাতা বিতরণের নামে নগদে বড় ধরনের অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে।
প্রশাসনের তদন্তে উঠে এসেছে, অনেক ভাতাভোগীর টাকা বিতরণ না করে নগদ নিজেই তুলে নিয়েছে।
যেসব ভাতাভোগী তিন দিনের মধ্যে তাদের ভাতা উত্তোলন করেননি, তাদের অর্থ গায়েব হয়ে যায়।
এছাড়া, একটি অঞ্চলের পরিবেশক ভিন্ন অঞ্চলের ভাতাভোগীদের অর্থ বিতরণ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
কুমিল্লার পরিবেশক রংপুরের ভাতাভোগীদের টাকা বিতরণ করেছে বলে নথিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
সরকারি ভাতা বিতরণে নিয়োজিত থাকার কারণে নগদ এই অনিয়মগুলো সহজেই করতে পেরেছে।
ভাতাভোগীদের কাছে পৌঁছানোর আগেই ভাতার অর্থ লোপাট হওয়া দেশের আর্থিক ব্যবস্থায় বড় ধাক্কা দিয়েছে।
প্রশাসক দল এই অর্থ লোপাটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে কাজ করছে।
সরকারি ভাতার অর্থ লোপাটের কারণে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রশাসক দলের পদক্ষেপ
কেন্দ্রীয় ব্যাংক নগদে প্রশাসক বসানোর পর থেকেই তদন্তে অনিয়মের প্রকৃতি স্পষ্ট হতে শুরু করে।
প্রশাসক দল ৬৪৫ কোটি টাকার অতিরিক্ত ই-মানি ইস্যু এবং ১,৭১১ কোটি টাকা পরিবেশক হিসাবে তোলার বিষয়টি চিহ্নিত করেছে।
অনিয়মে জড়িত ছয়জন শীর্ষ কর্মকর্তার একটি তালিকা তৈরি করে ডাক অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
এই ছয় কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন নগদের নির্বাহী পরিচালক, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো আইনি পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।
নগদে অনিয়ম বন্ধ করতে প্রশাসক দল অতিরিক্ত ই-মানি ইস্যু বন্ধ করেছে।
তদন্তের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে নগদকে স্থায়ীভাবে পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হবে কিনা, তা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
প্রশাসক দল এখন নগদের ভবিষ্যৎ পরিচালনা কাঠামো এবং দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে কাজ করছে।