বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির খবর পাওয়া যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থাহীনতা এর মূল কারণ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে।
ব্যবসায় স্থবিরতা: উৎপাদন ও সরবরাহে ধীরগতি
দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চার মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ১১২ কোটি টাকা।
এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা।
আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক), এবং আমদানি শুল্ক—সব খাতেই বড় ধরনের ঘাটতি দেখা গেছে।
উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনে ধীরগতি দেখা দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা লাভজনকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন না।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তাদের চাহিদা কমে যাওয়ায় বিক্রির পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে।
ব্যবসায়ীদের অনেকে নতুন বিনিয়োগে উৎসাহী নন এবং বর্তমান কার্যক্রমেও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।
আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক খাতে ঘাটতি
আয়কর খাতে চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে।
লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৫ হাজার ২৪২ কোটি টাকা, কিন্তু আদায় হয়েছে ৩২ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা।
মূসক খাতে ১১ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির বিপরীতে আদায় হয়েছে ৩৬ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা।
আমদানি শুল্ক খাতে ঘাটতি প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।
আমদানির পরিমাণ কমে যাওয়া, শুল্ক ছাড়, এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এ খাতে আয় কমেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, ডলার সংকটের কারণে তারা এলসি খুলতে পারছেন না।
এলসি সমস্যার ফলে কাঁচামাল ও পণ্য আমদানি ব্যাহত হচ্ছে, যা উৎপাদন ও সরবরাহে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও রাজস্ব ঘাটতির সম্পর্ক
জুলাই-আগস্টে দেশজুড়ে চলা ছাত্র-জনতার আন্দোলন অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে অনেকাংশে স্থবির করে দেয়।
বেশ কয়েক দিন কারফিউ এবং ছুটির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা তৈরি হয়।
আগস্ট মাসে সরকার পরিবর্তনের পরও ব্যবসায়িক পরিবেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি।
বাজারে সরবরাহ চেইনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বী।
বোতলজাত ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন পণ্য বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান অস্থিরতার ফলে ব্যবসায়ীদের নতুন বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকার প্রবণতা বেড়েছে।
প্রশাসনিক অকার্যকারিতা ও ব্যবসায়ীদের শঙ্কা
ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা না থাকায় তারা ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন।
বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলার প্রবণতা বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এনবিআরকে দেওয়া রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা তাদের সক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি।
বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জানান, ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি না ফিরলে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি চলতেই থাকবে।
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন করজাল সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি না হলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে রাজস্ব খাত
বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
আইএমএফের শর্ত পূরণে বছরে জিডিপির দেড় শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে।
২০২৭ সালের মধ্যে কর ছাড় পুরোপুরি তুলে দেওয়ার শর্তও মানতে হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সরকারকে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে আরও বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।