,

চিন্ময় দাসের জামিন শুনানি: হুমকি, বাধা ও আইনি অধিকার নিয়ে বিতর্ক

চট্টগ্রামের আদালতে চিন্ময় দাসের জামিন শুনানি ঘিরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

আইনজীবীদের ওপর হামলা, হুমকি এবং বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

২৬ নভেম্বর সংঘর্ষে একজন আইনজীবীর মৃত্যু এবং তার প্রেক্ষিতে নতুন মামলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।

অধিকাংশ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডে দোষীদের শাস্তি দাবিতে চিন্ময় দাসের পক্ষে আদালতে দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

এই ঘটনার ফলে আসামির আইনি অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করছে।

মামলার এই জটিলতার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও ঘটনাটির ওপর নজর রেখেছে এবং সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।

মামলার পটভূমি

চিন্ময় দাস হলেন চট্টগ্রামের সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র।

তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়েছে।

গত ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম সিএমএম আদালতে তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর হলে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

তাকে কারাগারে পাঠানোর সময় আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ শুরু হয়।

বিক্ষোভ থেকে সহিংসতায় রূপ নিয়ে সংঘর্ষে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হন।

এই ঘটনায় অন্তত ৩০ জন আহত হন, যার মধ্যে বেশ কয়েকজন আইনজীবী ও পুলিশ সদস্য ছিলেন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগে।

এই ঘটনায় পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়, যার মধ্যে একটি হত্যা মামলা।

হত্যা মামলার পাশাপাশি ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ এবং পুলিশের কাজে বাধাদানের অভিযোগে আরও চারটি মামলা করা হয়।

মামলাগুলোর আসামির তালিকায় ৭০ জন হিন্দু আইনজীবী, দুইজন সাংবাদিক এবং অসংখ্য অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি রয়েছেন।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতি নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামের বিচার দাবি করে।

সমিতি থেকে আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়, তারা যেন এসব মামলায় আসামিদের পক্ষে না দাঁড়ান।

আদালতে আইনজীবীদের অনুপস্থিতি

তেসরা ডিসেম্বর চিন্ময় দাসের জামিন শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়।

তবে ওইদিন আদালতে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না।

মামলার শুনানি পেছানোর জন্য রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সময়ের আবেদন জানানো হয়।

আদালত শুনানির পরবর্তী তারিখ ২ জানুয়ারি নির্ধারণ করে।

আইনজীবীদের অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সমিতির পক্ষ থেকে আসামিদের পক্ষে মামলা না লড়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল।

এছাড়া আইনজীবীদের ওপর নানা ধরনের হুমকি ও চাপের অভিযোগও পাওয়া গেছে।

বিভিন্ন হিন্দু আইনজীবীর চেম্বারে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

এমনকি যারা আসামিদের পক্ষে মামলা লড়তে চেয়েছিলেন, তাদের ওপর গণপিটুনির হুমকি দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, হত্যাকাণ্ডের মামলাগুলোতে আইনজীবীদের অংশ না নেওয়ার জন্য তাদের অনুরোধ করা হয়েছে।

তিনি দাবি করেন, আইনজীবীদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো হুমকি নেই।

তবে ভুক্তভোগী আইনজীবীরা এ বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেছেন।

একজন সিনিয়র আইনজীবী কাজী মফিজুর রহমান বলেন, জামিন শুনানিতে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করলেও তাকে বাধ্য হয়ে পিছু হটতে হয়েছে।

তার মতে, “ওকালতনামা দেওয়া আমাদের সাংবিধানিক অধিকার, কিন্তু আমরা কেউ নিরাপদ নই।”

তিনি আরও জানান, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে তাকে মিথ্যা প্রচারণার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

চিন্ময় দাসের পক্ষে একজন আইনজীবী দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে, তাকে শারীরিক হামলার শিকার হতে হয়েছে।

এর আগে, আইনজীবী রিগ্যান আচার্যের ওপর হামলা এবং তার চেম্বারে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

সমিতি থেকে এমনকি অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটরদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে, যারা আসামিদের পক্ষে মামলা লড়তে চেয়েছিলেন।

আইনজীবীদের এই অনুপস্থিতি এবং বাধার পরিবেশ চিন্ময় দাসের আইনি অধিকারকে সংকুচিত করেছে বলে মত দেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

আদালতে আইনজীবী না থাকা সত্ত্বেও মামলাটি নথিভুক্ত রাখা হয়েছে এবং পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।

আইনি প্রক্রিয়ার এই ব্যত্যয়কে অনেকেই বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতার ওপর হুমকি হিসেবে দেখছেন।

মানবাধিকার এবং আইনি বিতর্ক

চিন্ময় দাসের মামলাটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত হিসেবে আলোচনা পাচ্ছে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতে আইনজীবীর অনুপস্থিতি একটি গুরুতর সমস্যা।

প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষ থেকে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানও এই অধিকার নিশ্চিত করে।

আইনি সহায়তা না পাওয়ার বিষয়টি সরাসরি সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, এটি আসামির পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থনের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদেও অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য ন্যায্য বিচার পাওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো আদালতে ঘটে যাওয়া সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে।

তারা বলেছে, আইনজীবীদের ওপর হামলা এবং হুমকি বিচারব্যবস্থার স্বচ্ছতাকে ব্যাহত করে।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এক বিবৃতিতে বিষয়টি তদন্তের দাবি জানিয়েছে।

তারা বলেছে, “কোনো নাগরিক যদি তার পক্ষে কথা বলার সুযোগ না পায়, তা হলে বিচারপ্রক্রিয়া সঠিক পথ হারায়।”

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, মামলাটি বাংলাদেশের আইনের শাসনের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছে।

তারা আরও বলেছে, “সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা হওয়ায় চিন্ময় দাসের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠতে পারে।”

সরকারি প্রসিকিউটররা বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন।

তারা মনে করেন, আইনজীবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা হলে ভবিষ্যতে আরও বড় সংকট তৈরি হতে পারে।

চট্টগ্রামের স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিষয়টি নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে।

তারা বলেছে, “আইনজীবীরা যদি ভয়ভীতি কিংবা চাপের কারণে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে না পারেন, তাহলে বিচার ব্যবস্থায় আস্থা কমে যাবে।”

আইনি বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, এটি আইনজীবীদের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া

চিন্ময় দাসের মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের নজর রয়েছে।

ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস থেকে এই বিষয়ে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।

তারা বলেছে, “আমরা বিশ্বাস করি প্রত্যেক ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।”

মার্কিন দূতাবাস ঘটনাটির ওপর গভীর নজর রাখছে বলে জানিয়েছে।

তারা বলেছে, বিচার প্রক্রিয়ায় সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত হওয়া উচিত।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টও এ ঘটনার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে।

তারা বলেছে, “বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা দেওয়া এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি।”

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই বিবৃতি বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সরব।

সম্প্রতি মার্কিন ভিসা নীতিতে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ভূমিকার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

চিন্ময় দাসের মামলাটি সেই প্রেক্ষাপটেই গুরুত্ব পাচ্ছে।

মার্কিন সিনেটররাও এই বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।

তারা বলেছেন, “সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা যদি সুবিচার না পান, তবে এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে দুর্বল করবে।”

ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি

চিন্ময় দাসের মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় বাড়ছে।

তাকে জামিন দেওয়া হবে কি না, তা ২ জানুয়ারির শুনানির পরই জানা যাবে।

যদিও আইনজীবীদের একটি অংশ বলছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে জামিন পাওয়া কঠিন।

চট্টগ্রামের আদালতে উত্তেজনা এখনও পুরোপুরি কমেনি।

আইনজীবীরা নিহত সহকর্মীর বিচার দাবি অব্যাহত রেখেছেন।

একটি পক্ষ বলছে, চিন্ময় দাসের মুক্তি পেলে নতুন করে সহিংসতা সৃষ্টি হতে পারে।

অন্যদিকে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো দ্রুততার সঙ্গে আইনি প্রক্রিয়া চালানোর দাবি জানিয়েছে।

তারা বলছে, “প্রত্যেক ব্যক্তির আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার রয়েছে।”

বিভিন্ন মহল মনে করছে, মামলাটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে প্রভাবিত করতে পারে।

বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আদালতে নিরাপত্তা জোরদার করেছে।

তারা বলছে, “পরবর্তী শুনানিতে কোনো রকম বিশৃঙ্খলা এড়াতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃত্বকে হুমকির মুখে ফেলা বিচার ব্যবস্থার জন্য একটি অশনিসঙ্কেত।

চিন্ময় দাসের পক্ষে এবং বিপক্ষে সমর্থনকারীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে।

কিছু রাজনৈতিক দল বিষয়টিকে পুঁজি করে মাঠে নামতে চাচ্ছে।

মামলাটির পরিণতি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এবং মানবাধিকার রক্ষার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে।

আরও পড়তে পারেন