,

বাংলাদেশের সেবাখাতে ১৫ বছরে দুর্নীতির মূল্য ১.৪৬ লাখ কোটি টাকা: টিআইবি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সম্প্রতি তাদের “সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় গৃহস্থালী জরিপ ২০২৩” প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদনটি ২০১০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ছয়টি গৃহস্থালী জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি করা হয়েছে।

এতে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে দুর্নীতির কারণে সেবাগ্রহীতাদের ১.৪৬ লাখ কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।

জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৫,৫১৫টি পরিবারের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে।

এতে দেখা গেছে, মে ২০২৩ থেকে এপ্রিল ২০২৪-এর মধ্যে ৭০.৯ শতাংশ গৃহস্থালী সেবা গ্রহণের সময় দুর্নীতির শিকার হয়েছে।

এই সময়ে সেবাগ্রহীতারা মোট ১০,৯০২ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছে।

এটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত জাতীয় বাজেটের ১.৪ শতাংশ এবং দেশের মোট জিডিপির ০.২ শতাংশ।

জরিপের তথ্য তুলে ধরে টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, দুর্নীতি দমনের জন্য বিদ্যমান টুলগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না।

তিনি বলেন, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার প্রতিশ্রুতি কেবল কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।”

সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সেবাখাতগুলো

টিআইবির প্রতিবেদনে সেবা প্রদানকারী ১৭টি খাতের দুর্নীতি চিহ্নিত করা হয়েছে।

পাসপোর্ট অধিদপ্তরকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সেবা খাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

জরিপে অংশ নেওয়া ৮৬ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির সম্মুখীন হয়েছেন।

এরপর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ), যেখানে ৮৫.২ শতাংশ সেবাগ্রহীতা দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৃতীয় স্থানে রয়েছে, যেখানে ৭৪.৫ শতাংশ মানুষ দুর্নীতি অনুভব করেছেন।

বিচার বিভাগ এবং ভূমি সেবায়ও দুর্নীতির মাত্রা উল্লেখযোগ্য বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

জরিপে দেখা গেছে, বিচার বিভাগের সেবা গ্রহণে পরিবারপ্রতি গড়ে ৩০,৯৭২ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।

ভূমি সংক্রান্ত সেবার ক্ষেত্রে গড় ঘুষের পরিমাণ ১১,৭৭৬ টাকা।

তালিকার তৃতীয় স্থানে থাকা ব্যাংকিং সেবায় গড় ঘুষের পরিমাণ ৬,৬৮১ টাকা।

টিআইবির তথ্য অনুযায়ী, সেবা খাতগুলোর বেশিরভাগেই সেবাগ্রহীতাদের ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়া অসম্ভব।

৭৭.২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, “ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়া যায় না।”

দুর্নীতির সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব

দুর্নীতি শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং সামাজিক বৈষম্যও বাড়াচ্ছে।

জরিপে দেখা গেছে, কম আয়ের পরিবারগুলো দুর্নীতির কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

যেসব পরিবারের মাসিক আয় ২৪ হাজার টাকার নিচে, তারা বার্ষিক আয়ের ০.৯৩ শতাংশ ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে।

অন্যদিকে, যেসব পরিবারের মাসিক আয় ৮৫ হাজার টাকার বেশি, তাদের ক্ষেত্রে এই হার ০.২১ শতাংশ।

দুর্নীতির প্রভাব নারীদের ওপরও বেশি পড়ছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী এবং প্রতিবন্ধীরা দুর্নীতির কারণে অতিরিক্ত সামাজিক ও আর্থিক চাপের মুখে পড়েছেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশ, শুধুমাত্র ঘুষ নয়, বরং উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিতেও জড়িত বলে টিআইবি দাবি করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতির কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

টিআইবি বলেছে, “দুর্নীতির প্রভাব বিশেষত দরিদ্রদের জন্য সেবা গ্রহণ আরও কঠিন করে তুলছে।”

দুর্নীতি রোধে টিআইবির সুপারিশ

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দুর্নীতি প্রতিরোধে নয়টি সুপারিশ পেশ করেছে।

প্রথমত, সেবাখাতগুলোতে ডিজিটালাইজেশন কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, প্রতিটি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য হালনাগাদ আচরণবিধি প্রণয়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

টিআইবি বলেছে, দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

সেবা খাতের প্রতিটি পর্যায়ে মনিটরিং এবং জবাবদিহিতার কাঠামো জোরদার করার সুপারিশও উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে জনগণের সচেতনতা বাড়াতে দুর্নীতি বিরোধী সামাজিক আন্দোলনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, “শূন্য সহনশীলতার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত না হলে দুর্নীতি বাড়তেই থাকবে।”

তিনি বলেন, দুর্নীতি রোধে আন্তরিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

জনগণের দুর্নীতি অভিজ্ঞতা ও প্রতিবন্ধকতা

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের একটি বড় অংশ বলেছে, সেবা পেতে ঘুষ দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

৭৭.২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, “ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়া সম্ভব নয়।”

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মাত্র ০.৬ শতাংশ ভুক্তভোগী দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন।

অভিযোগ না করার কারণ হিসেবে ৪৫ শতাংশ বলেছেন, “সিস্টেমটাই দুর্নীতিগ্রস্ত, অভিযোগ করে লাভ নেই।”

২৯.৭ শতাংশ বলেছেন, তারা জানেন না কীভাবে অভিযোগ করতে হয়।

অন্তত ৪৭.৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন, শাস্তিহীনতার কারণে দুর্নীতি বেড়েছে।

জরিপে ৬০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, দুর্নীতি নিয়ে কোথায় অভিযোগ করতে হবে তা তারা জানেন না।

টিআইবি বলেছে, দুর্নীতির কারণে জনগণের মাঝে এক ধরনের অসহায়ত্ব তৈরি হয়েছে।

টিআইবির এক গবেষক বলেছেন, “যারা দুর্নীতির শিকার হন, তারা ভয় পান যে অভিযোগ করলে আরও হয়রানি হতে পারে।”

দুর্নীতি প্রতিরোধে টিআইবির আহ্বান

টিআইবি মনে করে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুর্নীতি দমনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, “অন্তর্বর্তী সরকার যদি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতের জন্য একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি হবে।”

তিনি বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সেবা গ্রহণে যে ধরনের দুর্নীতি হয়, তার জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য।

টিআইবি আরও বলেছে, শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে দুর্নীতি শুধু বাড়তেই থাকবে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি জাতীয় পর্যায়ের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছে টিআইবি।

প্রতিবেদন বলেছে, দুর্নীতির মাধ্যমে আদায় হওয়া অর্থের বড় অংশ দরিদ্র জনগণের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলছে।

অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিকল্প নেই।

টিআইবি মনে করে, বাংলাদেশে দুর্নীতির মূলে প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা এবং জবাবদিহিতার অভাব।

জরিপের মাধ্যমে দুর্নীতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে টিআইবি বলেছে, সময় এসেছে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার।

আরও পড়তে পারেন