নদীর সংখ্যা নির্ধারণে শুরু হওয়া উদ্যোগ নিয়ে বিতর্ক চরমে পৌঁছেছে।
দেশের সরকারি তালিকা থেকে অন্তত ২৭৪টি নদীর নাম বাদ পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাচাই-বাছাই ছাড়া তালিকা চূড়ান্ত করার ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
সরকারি সংস্থাগুলোর তালিকা ও স্থানীয় জনগণের দাবির মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য দেখা যাচ্ছে।
চামটা নদীসহ একাধিক নদীর চিহ্ন বিলুপ্ত হওয়ার পথে
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী থেকে নেওয়াশী ইউনিয়নের রাস্তার পাশে চামটা নদীর অস্তিত্ব এখন প্রায় অদৃশ্য।
একসময় প্রবাহমান এ নদীর জায়গায় এখন চাষ করা হচ্ছে ধান ও মাছ।
চামটা নদীর জায়গায় একটি সরু নালা ছাড়া আর কোনো চিহ্ন নেই।
সরকারি কোনো সংস্থার তালিকায় নদীটির নাম নেই।
জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের তালিকায় নদীর নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জেলা প্রশাসন উদ্যোগ নেয়নি।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল চামটা নদী পরিদর্শন করে।
তারা এক প্রতিবেদনে জানায়, হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারণ ও দখলমুক্ত করার কাজ দ্রুত করা উচিত।
কিন্তু রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের তালিকায় চামটা নদীর নাম যুক্ত করা হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, প্রভাবশালীরা নদীর জায়গা দখল করে স্থায়ীভাবে চাষাবাদ করছেন।
রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের দখলে নদীর জায়গা
তালিকা থেকে বাদপড়া বেশিরভাগ নদীর জায়গা অবৈধভাবে দখল করে নেওয়া হয়েছে।
নদীর দখল পাকাপোক্ত করতে যাচাই-বাছাই ছাড়াই তালিকা চূড়ান্ত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জের বারশিয়া নদী এর একটি উদাহরণ।
এই নদীর পানি সেচের কাজে ব্যবহৃত হয় এবং স্থানীয় জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।
তবুও নতুন তালিকায় নদীটির নাম নেই।
একইভাবে ঝালকাঠির বাউকাঠি নদীর নাম সরকারি তালিকায় খালের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন গত বছর এটি নদী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল।
নদীরক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মন্জুর আহমেদ চৌধুরী জানিয়েছেন, শুধুমাত্র পানিপ্রবাহ নয়, ভূমির রেকর্ডের ভিত্তিতে নদীর তালিকা চূড়ান্ত হওয়া উচিত।
তালিকা প্রণয়নে অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বর্তমান তালিকায় দেশের নদীর সংখ্যা ৬৮৫টি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে দুই থেকে তিন হাজার নদী রয়েছে।
পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম ইনামুল হকের বইয়ে ১,১৮০টি নদীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের খসড়া তালিকায় ১,০০৮টি নদীর নাম ছিল, যা এখন আরও কমে এসেছে।
তালিকায় অনেক নদীর নাম বাদ যাওয়ার কারণ হিসেবে স্থানীয় ও দাপ্তরিক নামের ভিন্নতা উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরেজমিন গবেষণা ছাড়া তালিকা প্রণয়ন করা হলে প্রকৃত তথ্য উঠে আসবে না।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভায় আঞ্চলিক নাম অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেও এ সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
তালিকায় বাদপড়া নদীর পরিবেশগত গুরুত্ব
নেত্রকোনার মাটিয়ারা ও খুলনার কিচিমিচি নদীসহ কয়েকটি নদী প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নদীগুলোর পানি কৃষিকাজ, মৎস্যচাষ এবং স্থানীয় মানুষের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হয়।
সিলেটের বিগাং ও কুশি নদী স্থানীয় জীববৈচিত্র্য এবং পর্যটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তালিকা থেকে বাদপড়া নদীগুলোর অধিকাংশই স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য আয় ও জীবিকার উৎস।
বাউকাঠি নদীর পাশে স্থানীয়রা এখনও ঈদের সময় ঘুরতে যান এবং উৎসব উদযাপন করেন।
তবে নদীর নাম বাদ দেওয়ার মাধ্যমে দখলদারদের সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা।
পরিবেশবিদরা সতর্ক করেছেন, নদীর সংখ্যা কমিয়ে আনার যে প্রক্রিয়া চলছে, তা দেশের প্রতিবেশব্যবস্থার ওপর দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে।
সরকারি সংস্থাগুলোর উচিত জনগণের অভিযোগ আমলে নিয়ে তালিকা পুনর্মূল্যায়ন করা।