ঢাকার শাহবাগে এক বিরল সমাবেশে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারো নিম্ন আয়ের মানুষকে আনা হয়েছিল।
ঋণের প্রলোভন দেখিয়ে সংগঠিত এই সমাবেশে অংশগ্রহণকারী অনেকেই শেষ মুহূর্তে বুঝতে পারেন, তারা একটি প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন।
পুলিশ রবিবার রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত প্রায় তিন শতাধিক বাস ও মাইক্রোবাস আটক করে, যা পুরো ঘটনা নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
ঘটনাটির প্রেক্ষাপট
কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা অংশগ্রহণকারীরা জানান, তাদের ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল।
তাদের অনেকেই বলছেন, এক লাখ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া হবে—এমন প্রতিশ্রুতি তাদেরকে এই সমাবেশে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।
এই প্রলোভনের শিকার জাকির হোসেন ভুইয়া, সাভারের এক গার্মেন্টস কর্মী, বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গ্রামে আমার মায়ের মাধ্যমে একটি চক্র আমার রেজিস্ট্রেশন করিয়েছে এবং আমাদের কাছ থেকে ৫০০ টাকাও নিয়েছে।”
জাকিরসহ অনেকেই জানান, তাদের গ্রামের স্থানীয় ব্যক্তি ও একটি সংগঠন মিলে এই প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করেছিল।
সমাবেশে যোগ দিতে আসা প্রায় সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ, যাদের কেউ জুতা বিক্রি করেন, কেউ গার্মেন্টসে কাজ করেন।
অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই এই সমাবেশে এক ধরনের “উপহারমূলক ঋণ” পাবার প্রত্যাশা করেছিলেন।
পুলিশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই সমাবেশের পেছনে একটি ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
মূল পরিকল্পনা ও প্রতারণার ধরন
ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে আসার পরিকল্পনা এক মাস আগেই শুরু হয়েছিল।
কিশোরগঞ্জের ফরিদপুর গ্রামের মিনারা বেগমের কাছে প্রায় এক মাস আগে কিছু ব্যক্তি এসে তাদের পরিকল্পনার কথা জানান।
তারা নিজেদের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আসা প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দেন এবং ঋণের জন্য এনআইডি ও ছবি সংগ্রহ করেন।
মিনারা বেগমের ছেলে জাকির হোসেনের কাছে রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ ৫০০ টাকা নেয়া হয় এবং একটি রেজিস্ট্রেশন কার্ড দেয়া হয়।
ঢাকায় এসে ঋণের টাকা নেয়ার জন্য ২৫ নভেম্বর শাহবাগের সমাবেশে যোগ দেয়ার কথা বলা হয়।
এ ঘটনায় অনেক অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, তাদের স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন।
মানিকগঞ্জের দবির উদ্দিনসহ কয়েকজন ব্যক্তি সমাবেশে লোক নিয়ে আসার অভিযোগে আটক হয়েছেন।
ঋণের আশায় আসা মানুষদের কাছে ‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের লিফলেট পাওয়া গেছে।
এই লিফলেটে লেখা ছিল, বিনা সুদে এবং বিনা জামানতে ঋণ দেয়া হবে, যা দারিদ্র্য দূর করবে।
পুলিশ জানায়, সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে ঋণের জন্য ফরম পূরণ করা হয়েছিল, যেখানে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
ঘটনাস্থলে সংঘটিত কার্যক্রম
রবিবার রাত থেকেই ঢাকার শাহবাগ এলাকায় শত শত বাস ও মাইক্রোবাস আসতে শুরু করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদের দাবি, গাড়িগুলোতে যারা আসছিলেন, তারা বেশিরভাগই কিছু জানতেন না।
রাতের আঁধারে ঢাকায় এসে উপস্থিত হওয়া মানুষজনের মধ্যে গর্ভবতী নারী এবং বয়স্করাও ছিলেন।
এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সতর্ক অবস্থান নেন এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন।
পুলিশ, মধ্যরাত থেকে সক্রিয় হয়ে, গাড়িগুলো আটক করতে থাকে এবং সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।
সমাবেশের অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে এত মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পুলিশ জানায়, এই ঘটনার পেছনে একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের আভাস রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ পুরো বিষয়টিকে একটি “সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র” হিসেবে দেখছে।
পরবর্তী অংশে থাকবে: জড়িত ব্যক্তিদের পরিচয়, প্রশাসনের ভূমিকা এবং গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
জড়িত ব্যক্তিদের পরিচয় ও আটক
পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থলে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠনের নেতাদের আটক করা হয়েছে।
এই সংগঠনের আহ্বায়ক আ ব ম মোস্তফা আমীনকে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
মোস্তফা আমীন আগে ফরোয়ার্ড পার্টি নামক একটি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।
মানিকগঞ্জ থেকে লোক আনার অভিযোগে দবির উদ্দিন নামে এক স্থানীয় ব্যক্তিকে তার স্ত্রীসহ আটক করা হয়েছে।
পুলিশের মতে, দবির উদ্দিন স্থানীয় ব্যবসায়ী হলেও তিনি কীভাবে এই পরিকল্পনার সাথে যুক্ত হলেন, তা জানতে তদন্ত চলছে।
জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রতারণা এবং জননিরাপত্তা বিঘ্নের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
তবে, ঘটনাটির সাথে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ সংযোগ এখনও সুনিশ্চিত করা যায়নি।
গোয়েন্দা ব্যর্থতা ও প্রশাসনের ভূমিকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ বলেছেন, এত বড় একটি সমাবেশের পরিকল্পনা গোয়েন্দা নজরদারিতে ধরা পড়েনি, যা উদ্বেগজনক।
পুলিশ বলছে, ঘটনাটি সম্পর্কে তারা আগে থেকে অবগত ছিলেন না, কিন্তু জানতে পারার পর দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এবং পুলিশের মাঝে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি এই ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এই ধরনের সংগঠিত কার্যক্রম ভবিষ্যতে জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।
অংশগ্রহণকারীদের হতাশা ও প্রতারণার শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা
সমাবেশে আসা মানুষেরা বলেছেন, তারা ঋণ পাওয়ার প্রতিশ্রুতিতে এতদূর এসেছিলেন, কিন্তু এসে তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
কিশোরগঞ্জের জাকির হোসেন ভুইয়া বলেন, “আমি সত্যিই ভেবেছিলাম এখানে এসে ঋণ পাব, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি এটা একটা ষড়যন্ত্র।”
মানিকগঞ্জ থেকে আসা আমিন মিয়া বলেন, “আমার মতো গরিব মানুষকে এভাবে ধোঁকা দেয়া খুবই দুঃখজনক।”
অনেকে জানিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন ফি নেয়া হয়েছিল, যা তারা আর ফেরত পাবেন না বলে মনে করছেন।
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী পদক্ষেপ
সরকারি মহল থেকে এখনো সরাসরি প্রতিক্রিয়া আসেনি, তবে প্রশাসন বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করছে।
পুলিশ জানিয়েছে, আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সরকারের কাছে অনুরোধ করেছে, ভবিষ্যতে এমন কার্যক্রম প্রতিরোধে বিশেষ নজরদারি বাড়ানোর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায় এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সক্রিয় হতে হবে, এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।