রাজধানী ঢাকায় রিকশাচালক কামাল মিয়ার হত্যাকাণ্ড নিয়ে মামলা ঘিরে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। একই সঙ্গে ভুয়া মামলা এবং মামলার পেছনে অসৎ উদ্দেশ্যের প্রবণতা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে অনেকে মামলার নামে হয়রানি এবং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছেন।
নিহত রিকশাচালকের পরিবারে চাপাচাপি ও প্রলোভন
কামাল মিয়ার স্ত্রী ফাতেমা খাতুন জানান, একাধিক ব্যক্তি তাঁর কাছে মামলা করার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন।
তাঁর বক্তব্য, “স্বামীকে হারিয়েছি, মাথাব্যথা আমার। নির্দোষ ব্যক্তিদের ফাঁসানোর কোনো ইচ্ছা নেই। আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে।”
ফাতেমা আরও বলেন, তাঁর স্বাক্ষর ছাড়াই অন্য কেউ কামাল হত্যার ঘটনায় নতুন মামলা করেছেন। শাহরিয়ার শুভ নামে একজন ব্যক্তি আদালতে ২৮১ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন।
ফাতেমার ভাষায়, “আমি শুভকে চিনি না। সে কীভাবে মামলা করল? খোঁজ পেলে তার বিরুদ্ধে মামলা করব।”
ফাতেমা ইতিমধ্যে একটি মামলা করেছেন। কিন্তু নতুন মামলাটি নিয়ে তিনি কিছুই জানতেন না।
এক ঘটনায় একাধিক মামলা ও অসংগতি
একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে পুরান ঢাকার রিকশাভ্যান চালক রিপনের মৃত্যু নিয়ে।
গণআন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান রিপন। তাঁর স্ত্রী শামীমা আকতার রুমার করা মামলার পর রিপনের মা সুফিয়া বেগমও আরেকটি মামলা দায়ের করেন।
দুই মামলার এজাহারে ঘটনা, স্থান এবং আসামিদের তালিকায় ব্যাপক পার্থক্য দেখা গেছে।
রুমার মামলায় উল্লেখ করা হয়, আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালান।
অন্যদিকে সুফিয়ার মামলায় বলা হয়, পুলিশের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা রিপনকে গুলি করেন।
ঢালাও মামলার তালিকায় ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ
কামাল মিয়ার ঘটনায় করা নতুন মামলার আসামিদের মধ্যে ফরিদপুরের ৬৪ জনের নাম রয়েছে।
তারা অভিযোগ করেছেন, কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই তাদের নাম মামলায় যুক্ত করা হয়েছে।
একজন ব্যবসায়ী জানান, “রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যবসা দখলের উদ্দেশ্যে আমাকে হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে।”
একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে আরও কয়েকটি মামলায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন আশুলিয়ায় একটি বিজয় মিছিল চলাকালে স্বামী নিহত হয়েছেন দাবি করে এক নারী মামলা করেন।
কিন্তু পরে সেই স্বামী জীবিত অবস্থায় থানায় উপস্থিত হয়ে জানান, তাঁর অজান্তে তাঁকে মৃত দেখিয়ে মামলা করা হয়েছে।
মিথ্যা মামলার প্রবণতা ও আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মিথ্যা মামলার প্রবণতা বেড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেছেন, “ঢালাও মামলার পেছনে কারা রয়েছে, তা বের করতে টাস্কফোর্স গঠন করা উচিত। দু-একজনকে গ্রেপ্তার করলে অন্যরা সতর্ক হবে।”
সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, “মিথ্যা মামলা করলে দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তবে তদন্তের মাধ্যমে নিরপরাধ ব্যক্তিদের নাম বাদ দেওয়া উচিত।”
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এআইজি ইনামুল হক সাগর জানিয়েছেন, নির্দোষ কেউ আসামি হলে তদন্তে তাদের নাম বাদ দেওয়া হবে।
ভুক্তভোগী পরিবারের মানসিক বিপর্যয়
মিথ্যা মামলা এবং মামলার নামে হয়রানি ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর জন্য বড় ধরনের মানসিক বিপর্যয় তৈরি করছে।
রিপনের স্ত্রী শামীমা বলেন, “একদিকে স্বামী হারিয়েছি, অন্যদিকে মামলা নিয়ে টানাহেঁচড়া চলছে। এভাবে কীভাবে চলব?”
এদিকে, কামাল মিয়ার স্ত্রী ফাতেমা জানান, মামলা নিয়ে আসা লোকজন তাঁদের সন্তানদের ভালো চাকরির প্রলোভন দিচ্ছেন।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, “মামলায় নির্দোষ ব্যক্তিদের জড়ালে বিবেকের কাছে কী জবাব দেব?”
সমাধানের পথে আলো
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হয়রানিমূলক মামলা বন্ধে আইনের প্রয়োগ এবং তদন্ত প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন এবং অভিযোগপত্রের সঠিক পর্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, ভুয়া মামলা দায়েরকারীদের আইনের আওতায় আনা হলে অন্যরা এ ধরনের কাজে লিপ্ত হতে সাহস পাবে না।