ড. মুহাম্মদ ইউনূস
,

বিচার নিশ্চিতের পরই আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে স্বাগত জানানো হবে

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং দেশের সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেছেন।

বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারে তিনি জাতীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে দেশে চলমান অস্থিরতা এবং সংস্কারের ছয় দফা কার্যক্রমের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

সাক্ষাৎকারে তিনি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে স্বাগত জানানোর বিষয়টি স্পষ্ট করলেও, তার আগে বিচারের মাধ্যমে দলটির অতীত কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা জোর দিয়ে বলেন।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য স্বাগত জানানো হবে।”

তবে তার আগে জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় জড়িত আওয়ামী লীগ এবং তাদের সহযোগীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

তিনি বলেন, “তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। বিচারে অপরাধী প্রমাণিত না হলে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার পাবে।”

ড. ইউনূস আরও বলেন, “যারা অপরাধী নয়, তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অন্যদের মতোই স্বাধীন। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আমরা রাজনৈতিক ভিত্তিতে লড়াই করব।”

এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি পরিষ্কার করেন যে, নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে বিচার নিশ্চিত করার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে।

তিনি আরও যোগ করেন যে, নির্বাচন পরিচালনা এবং গণতন্ত্র পুনর্গঠনের জন্য এ প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সহিংসতা, বিচারের প্রক্রিয়া এবং শেখ হাসিনার ভূমিকা

জুলাই ও আগস্ট মাসে ছাত্র আন্দোলনের সময় বিক্ষোভকারী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত এবং বহু আহত হন।

ড. ইউনূস বলেন, “এই হতাহতের ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেকের বিচার নিশ্চিত করা হবে।”

শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, “তিনি ভারতে আশ্রয় নিয়ে আবার কথাও বলছেন, যা আমাদের জন্য অনেক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

তিনি অভিযোগ করেন, শেখ হাসিনা ভারতে বসে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সহিংসতার জন্য দায়ের করা মামলাগুলোর প্রেক্ষিতে তাকে বাংলাদেশে ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ড. ইউনূস বলেন, “যদিও কেউ বিশ্বাস করে না যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরাতে রাজি হবেন।”

আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস সাধনের অভিযোগও তিনি তুলেছেন।

তিনি জানান, গত ১৫ বছরে সাড়ে তিন হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূতভাবে গুম হয়েছেন।

ছয় দফা সংস্কার পরিকল্পনা

দেশ পুনর্গঠনের জন্য ছয় দফা সংস্কার কার্যক্রমের বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, “রাষ্ট্র সংস্কারের কার্যক্রম মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করাই একমাত্র উপায়, যা স্বৈরাচারের ফিরে আসাকে রুখে দিতে পারে।”

এই ছয় দফা সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে:

• নির্বাচনী ব্যবস্থা: একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করা।

• পুলিশ প্রশাসন: প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব দূর করা।

• বিচারব্যবস্থা: বিচারব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করা।

• দুর্নীতি দমন কমিশন: শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা।

• সরকারি প্রশাসন: প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন।

• জাতীয় সংবিধান: সংবিধানের সংস্কার।

ড. ইউনূস বলেন, “এই সংস্কারই পুরো বিপ্লবের মূল। এ কারণেই আমরা একে বাংলাদেশ ২.০ বলছি।”

অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

ড. ইউনূস বলেন, “বিদেশে আওয়ামী লীগের হাজার কোটি ডলার পাচারের অর্থ উদ্ধারে কাজ করা হবে।”

এছাড়া তিনি আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর আস্থা ফেরানোর ওপর জোর দেন।

তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সংখ্যালঘুদের বিষয়ে কথা বলার আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করে বলেন, “ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী। আমরাও ব্যবসা নিয়ে ভাবছি। আমরা বিনামূল্যে অর্থ চাই না, বরং একটি ব্যবসায়িক অংশীদার চাই।”

নির্বাচনের রোডম্যাপ

নির্বাচন সম্পর্কে ড. ইউনূস বলেন, “আমরা কোনো তারিখ দিইনি। প্রথমে আমাদের রেলগুলো ঠিক করতে হবে যাতে ট্রেন সঠিক পথে চলে।”

তিনি বলেন, দ্রুত নির্বাচনের জন্য রোডম্যাপ নির্ধারণে কোনো তাড়াহুড়ো করা হবে না।

তবে বিএনপির তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান অন্তর্বর্তী সরকারের ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের পদ্ধতি নিয়ে সমালোচনা করেন।

তিনি বলেন, “কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা না করেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি একটি স্বৈরাচারী সরকারের লক্ষণ।”

সংকট নিরসনের সম্ভাবনা

বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে চলমান অন্তর্বর্তী সরকার স্বচ্ছ নির্বাচন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে কাজ করছে।

তবে এই প্রক্রিয়া আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া সফল হওয়া কঠিন।

ড. ইউনূস বলেছেন, “আমার লক্ষ্য রাষ্ট্র পুনর্গঠন এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।”

আরও পড়তে পারেন