শহীদ স্মরণসভায় আমন্ত্রণ না পেয়ে উত্তেজনা
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে আয়োজিত এক সভায় স্থানীয় বিএনপি নেতাদের আমন্ত্রণ না করার ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। সোমবার (১৩ নভেম্বর) এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বিএনপি নেতারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে কৈফিয়ত চাইতে গেলে, তাঁদের কথোপকথনের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
অডিওতে বিএনপির নেতারা ইউএনওর সঙ্গে কড়া ভাষায় কথা বলছেন এবং অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের নেতাদের উপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। যদিও প্রথম আলো অডিওটি যাচাই করতে পারেনি, তবে উভয় পক্ষই ইউএনও কার্যালয়ে এই আলোচনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
কী ঘটেছিল শহীদ স্মরণসভায়?
উপজেলা প্রশাসন গত সোমবার সকালে ইউএনওর কার্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মরণে একটি সভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে শহীদ পরিবারের সদস্য, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষার্থী এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা উপস্থিত ছিলেন।
তবে অনুষ্ঠানে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বিষয়টি জানতে পেরে বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়।
বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এই ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল নিয়ে ইউএনও কার্যালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়। তবে দলীয় শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে সেই পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। পরে মঠবাড়িয়া পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কে এম হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে কয়েকজন নেতা সন্ধ্যায় ইউএনও আবদুল কাইয়ূমের সঙ্গে দেখা করেন এবং আমন্ত্রণ না জানানোর বিষয়ে কৈফিয়ত চান।
ছড়িয়ে পড়া অডিও ক্লিপে কী শোনা যায়?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ৩ মিনিট ৪০ সেকেন্ডের অডিও ক্লিপে বিএনপি নেতাদের ক্ষোভ প্রকাশ এবং ইউএনওর ব্যাখ্যা দিতে শোনা যায়।
অডিওতে বিএনপি নেতা কে এম হুমায়ুন কবির ইউএনওর উদ্দেশে বলেন, ‘আমার কি বয়স কম? আমি স্টুডেন্ট পলিটিকস করছি ৯৬ সাল থেকে। আমি একটা কাগজ পাঠাইছি, সে আমার লোকরে আইন দেখায়। এরা আওয়ামী লীগ করে।’
অন্য এক নেতা বলেন, ‘গত কয়েক বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে প্রশাসন সাজিয়েছে, তাতে কেয়ারটেকার সরকার হিমশিম খাইতেছে।’
অন্যদিকে, ইউএনও আবদুল কাইয়ূমকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি তো এখানে কাউকে ডেকে আনিনি। এখন এখানে যদি কেউ আসে, আমি কি বলব আপনি যান।’
এ সময় বিএনপির একজন নেতা বলেন, ‘এখন কথা অইলো, জাতীয় যত প্রোগ্রাম হইবে, সেইখানে আমাদের প্রতিনিধিত্ব কীভাবে নিশ্চিত করবেন, সেটা আপনাকে করতে হবে।’
বিএনপি নেতাদের বক্তব্য
মঠবাড়িয়া পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কে এম হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদ স্মরণে আয়োজিত সভায় তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং মিছিল করতে চেয়েছিলেন। তবে তিনি নিজে তাঁদের নিবৃত্ত করেন এবং সন্ধ্যায় ইউএনওর কার্যালয়ে গিয়ে সরাসরি এ বিষয়ে কথা বলেন।
হুমায়ুন কবির আরও অভিযোগ করেন, ইউএনও বিভিন্ন সময়ে তাঁদের উপেক্ষা করছেন এবং সরকারি কার্যক্রমে আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাত দেখাচ্ছেন।
ইউএনওর প্রতিক্রিয়া
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল কাইয়ূম জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে আয়োজিত সভায় রাজনৈতিক নেতাদের আমন্ত্রণ জানানোর কোনো নির্দেশনা ছিল না। তিনি বলেন, ‘তাঁরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আবদার নিয়ে আসছেন। তবে সোমবার ছাত্রদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান ছিল, সেখানে তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ কারণে তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে সন্ধ্যায় আমার কার্যালয়ে এসেছিলেন।’
অডিও ক্লিপ নিয়ে বিতর্ক
ছড়িয়ে পড়া অডিও ক্লিপটি বিএনপির নেতা ও ইউএনওর কথোপকথনের প্রকৃত ধারা সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। এটি জনমনে প্রশ্ন তুলেছে, ইউএনও কি সত্যিই পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছেন, নাকি স্থানীয় রাজনৈতিক উত্তেজনা এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীরা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে আয়োজিত সভায় তাদের বাদ দেওয়ার মাধ্যমে সরকার তাঁদের গুরুত্ব কমানোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, উপজেলা প্রশাসনের দাবি, কোনো পক্ষপাতমূলক আচরণ করা হয়নি।
রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনায় রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, বিএনপি অযথা প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে, বিএনপি দাবি করেছে, বর্তমান প্রশাসন এখনো পুরোপুরি নিরপেক্ষ হতে পারেনি।
মঠবাড়িয়ার এই ঘটনা আরও বড় রাজনৈতিক সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় প্রশাসনের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থার সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা এবং সব পক্ষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানো সম্ভব। অন্যথায়, এ ধরনের বিতর্ক রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়াবে।