,

বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়, ছাত্রনেতাদের দাবি ফ্যাসিবাদ নির্মূল

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপের মধ্যে পড়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত এই সরকারের প্রতি জনগণের উচ্চ প্রত্যাশা থাকলেও, আওয়ামী লীগকে রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখার বিষয়ে ছাত্রনেতা ও বিএনপির ভিন্ন অবস্থান এখন মূল আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী শাসন এবং গণহত্যার অভিযোগ এনে তাদের বিচার ও নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন। অন্যদিকে, বিএনপি আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারের পক্ষে থাকলেও দল নিষিদ্ধের বিপক্ষে। এই পরিস্থিতিতে সরকার কীভাবে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করবে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়।

ছাত্রনেতাদের নিষিদ্ধ করার দাবি

জুলাই-অগাস্ট অভ্যুত্থানের সময় থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন ছাত্রনেতারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম সরাসরি বলেছেন, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার চেষ্টা প্রতিহত করতে প্রয়োজনে ‘দ্বিতীয় অভ্যুত্থান’ হবে।

হাসনাত আব্দুল্লাহ ফেসবুকে লেখেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে যারা ধারণ করে, তারা ২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করার দাবি ছাড়া আওয়ামী লীগ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আর কোনো বক্তব্য দিতে পারে না।’

অন্যদিকে, সারজিস আলম বলেন, ‘গণহত্যার বিচারের পূর্বে আওয়ামী লীগকে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেব না।’

ছাত্রনেতারা আরও দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে ফ্যাসিবাদী কাঠামো গড়ে উঠেছে, যা ধ্বংস না করলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।

বিএনপির অবস্থান

বিএনপি নেতারা বলেছেন, তারা আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচারের পক্ষে থাকলেও কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিপক্ষে। দলটির নেতারা মনে করেন, গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে জনগণই আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার বলেছেন, তাদের দল গণতন্ত্রের পক্ষে। গত সোমবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই না আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসুক। তবে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হতে পারে।’

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এক বক্তব্যে বিএনপির এই অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘বিএনপি বলেছে, সব রাজনৈতিক দল অবশ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। সুতরাং তারা ইতিমধ্যে রায় দিয়ে দিয়েছে। আমরা দেশের একটি প্রধান দলের মতামতকে উপেক্ষা করব না।’

সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা

অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। তবে সরকার একাধিক সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশের সংশোধনী।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, নতুন খসড়া আইনে আদালতকে সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তবে আদালত যদি মনে করেন, তাহলে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করতে পারবেন।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত রোববার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে।’

নির্বাচন নিয়ে মতভেদ

সরকার ও ছাত্রনেতারা সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের দিকে যেতে চান। তবে বিএনপি এই প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত না করে দ্রুত নির্বাচন চায়। দলটি মনে করে, বর্তমান সরকারের কাজ শুধুমাত্র নির্বাচন আয়োজন।

এ প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা স্থায়ী সরকার নই। কিন্তু নির্বাচনের আগে জরুরি কিছু সংস্কার প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।’

কূটনৈতিক চাপ ও ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সব দলের অংশগ্রহণ চায়। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের আন্ডার সেক্রেটারি ক্যাথেরিন ওয়েস্ট বলেছেন, ‘আমরা আশা করি, অধ্যাপক ইউনূস গণতন্ত্রের জন্য একটি রূপরেখা উপস্থাপন করবেন।’

তবে ছাত্রনেতারা কূটনৈতিক চাপকে পাত্তা দিতে নারাজ। তারা মনে করেন, জনগণের চাওয়া পূরণ করাই সরকারের প্রথম দায়িত্ব।

নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তে বিভক্ত রাজনৈতিক মহল

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে কি না, তা নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বোঝাপড়ার ওপর। এদিকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের আরও সময় প্রয়োজন।’

বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, আওয়ামী লীগ প্রশ্নে একমত হতে না পারলে ছাত্রনেতা ও বিএনপির মধ্যে মতভেদ আরও গভীর হতে পারে। এছাড়া, সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়া যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে নির্বাচন প্রক্রিয়াও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

আরও পড়তে পারেন