ড. মুহাম্মদ ইউনূস
,

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য: সংখ্যালঘুদের অধিকার, ট্রাম্প প্রশাসন এবং বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে তার মতামত তুলে ধরেছেন।

সাক্ষাৎকারটি সম্প্রচারিত হয় আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনের (কপ২৯) প্রেক্ষাপটে।

এতে তিনি সংখ্যালঘুদের অধিকার, চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের প্রেক্ষাপট এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন।

সংখ্যালঘুদের অধিকার ও সহিংসতার প্রশ্নে ড. ইউনূস

সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূসকে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উদ্বেগ নিয়ে তিনি কী ভাবছেন।

উত্তরে তিনি বলেন, “আমরা সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়ে কাজ করছি। সংবিধান তাদের স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিত করেছে। আমাদের দায়িত্ব তা বাস্তবায়ন করা।”

তবে যখন সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা বৃদ্ধির অভিযোগ উত্থাপিত হয়, ড. ইউনূস তা নাকচ করেন।

তিনি বলেন, “সহিংসতা বেড়েছে বলে আমি মনে করি না। বরং সহিংসতা কমেছে। বিপ্লবের সময় কিছু সহিংসতা ঘটেছিল, কিন্তু তা রাজনৈতিক চরিত্রের ছিল। এটি হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নয়। বরং আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্টদের ওপর ছিল।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা একটি পরিবারের মতো। আমাদের মতবিরোধ আছে, কিন্তু তা কোনোভাবেই আমাদের শত্রু বানায় না। আমরা সংবিধানের মাধ্যমে সবার অধিকার নিশ্চিত করছি।”

ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক: অপপ্রচার নাকি বাস্তবতা?

সাক্ষাৎকারে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয়।

ড. ইউনূস বলেন, “আমার ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্পের সঙ্গে কখনো কথা হয়নি। তাই তার সঙ্গে কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা নেই।”

তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উভয় প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, “আমার বন্ধু রয়েছে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট উভয় দলে। কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল দেওয়ার সময় উভয় দলের সমর্থন পেয়েছি। তাই ট্রাম্প প্রশাসন নিয়ে কোনো নেতিবাচক শঙ্কা দেখছি না।”

ট্রাম্পের মন্তব্য প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য অপপ্রচার। এটি ভারতীয় দিক থেকে আসা ভিত্তিহীন তথ্য। বাস্তবে সংখ্যালঘুদের অধিকাংশ উৎসব শান্তিপূর্ণভাবে উদ্‌যাপিত হয়েছে।”

শেখ হাসিনার পতন: অভ্যুত্থান নাকি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র?

ড. ইউনূসের কাছে জানতে চাওয়া হয়, শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন যে তার পতনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল।

তিনি সরাসরি এটি অস্বীকার করে বলেন, “এই ধরনের অভিযোগ হাস্যকর। শেখ হাসিনার পতন ছিল জনগণের বিপ্লব। শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমেছিল এবং দেশের মানুষ তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল।”

তিনি বলেন, “যখন গণ-অভ্যুত্থানকারীরা শেখ হাসিনার বাসার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন তার পরিবারই তাকে দেশত্যাগের পরামর্শ দেয়। সেনাবাহিনী তাকে ভারতে পালাতে সহায়তা করে। এটি কোনো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নয়, বরং দেশের মানুষের আন্দোলনের ফল।”

অভ্যুত্থানের সময়ে ড. ইউনূসের ভূমিকা

ড. ইউনূস বলেন, তিনি ওই সময় দেশে ছিলেন না এবং পরিস্থিতির প্রতি ঘণ্টার আপডেট জানতে পারতেন না।

তবে তার কাছে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ আসে। তিনি দেশে ফিরে শপথ নেন এবং সরকার গঠন করেন।

তিনি আরও বলেন, “আমি কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ ছিলাম না। এটি ছিল জনগণের বিপ্লব, যা কোনোভাবেই পরিকল্পিত ছিল না।”

আন্তর্জাতিক নীতির প্রভাব ও ভবিষ্যতের আশাবাদ

সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি একটি স্থিতিশীল কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে। এটি প্রেসিডেন্টের ওপর নির্ভর করে না।”

তিনি আশা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করবে এবং দেশে শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।

তিনি বলেন, “আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে আছি। আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য ন্যায়বিচার ও অধিকার নিশ্চিত করা।”

সামগ্রিক পর্যালোচনা

ড. ইউনূসের এই সাক্ষাৎকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে।

তিনি সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেন এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগকে নাকচ করেন।

তার মন্তব্যে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের আভাস পাওয়া যায়।

ড. ইউনূসের বক্তব্য স্পষ্ট করেছে, বাংলাদেশ নতুন একটি পথে হাঁটছে, যেখানে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের মূল্যবোধ অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

ভবিষ্যতে এই পথ কতটা মসৃণ হবে, তা নির্ধারণ করবে দেশি-বিদেশি নীতির সমন্বয় এবং অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ।

আরও পড়তে পারেন