বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাসের মাথায় তাদের কার্যকারিতা ও সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি দাবি করেছেন, জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি অগ্রাধিকার না দিয়ে এই সরকার এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে, যা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শনিবার ঢাকার রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয়তাবাদী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে তিনি এ বক্তব্য দেন। লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে তারেক রহমান বলেন, “সরকারকে ব্যর্থ করতে ষড়যন্ত্রকারীরা ওত পেতে আছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্ব ছিল জনগণের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক বজায় রাখা, যা তারা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।”
তারেক রহমান আরও দাবি করেন, দেশের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ষড়যন্ত্রকারীরা সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে সক্রিয়। “এরা যদি সফল হয়, তাহলে শুধু এই সরকারের ব্যর্থতা নয়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ওপরও কালিমা লেপিত হবে,” যোগ করেন তিনি।
অদক্ষতার প্রশ্নে জনমনে উদ্বেগ
তারেক রহমান অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার নির্ধারণের পদ্ধতি নিয়ে কটাক্ষ করেন। তিনি বলেন, “জুলাই-অগাস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার এমন একটি সময়ে দায়িত্ব নিয়েছে, যখন রাষ্ট্র এবং প্রশাসন উভয়ই ভেঙে পড়েছিল। এই বাস্তবতায় সরকারের ওপর জনগণের প্রত্যাশা ছিল অত্যন্ত উচ্চ। কিন্তু তাদের কর্মপদ্ধতিতে অদক্ষতার ছাপ স্পষ্ট।”
তিনি অভিযোগ করেন, “আহত আন্দোলনকারীদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন নিয়ে যে অবহেলা দেখা যাচ্ছে, তা সরকারের দায়িত্বহীনতার ইঙ্গিত দেয়। আহতরা এখন হাসপাতাল থেকে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে। এটি দেশের গণতান্ত্রিক চেতনার জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক একটি দৃশ্য।”
বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, “বাজার সিন্ডিকেট ভাঙার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় কত নম্বরে রয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। যদি এটি যথাযথভাবে সমাধান করা না হয়, তাহলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জনগণের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।”
ভোটাধিকার নিশ্চিতের ওপর জোর
গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, “জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে তাদের ভোটাধিকার। যদি তারা সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তবে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক আর গড়ে উঠবে না।”
তারেক রহমান আরও জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের উদ্যোগ ইতিবাচক। তবে তিনি সতর্ক করেন যে, এটি যেন শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ হয়ে না থাকে। “নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য সরকারকে এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে জনগণ নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে,” বলেন তিনি।
তারেক রহমান মনে করেন, বর্তমান সরকারকে জনগণের চাহিদার প্রতি আরও মনোযোগী হতে হবে। “জনগণ কেবল একটি অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম দেখতে চায় না, তারা একটি ভবিষ্যতবান্ধব এবং টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা আশা করে। এই সরকার যদি তা করতে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।”
অর্থনীতি ও রাজনীতির গভীর সম্পর্ক
তারেক রহমান বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী শাসনামলকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, “স্বৈরাচারী শাসনের সময়ে উন্নয়নের নামে মেগা প্রকল্পের আড়ালে যে আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। এ ধরনের উন্নয়ন কখনো টেকসই হতে পারে না।”
তিনি আরও বলেন, “রাজনীতি যদি রুগ্ণ হয়, তাহলে অর্থনীতিও রুগ্ণ হবে। বাংলাদেশ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া অর্থনীতিকে সুসংগঠিত রাখা সম্ভব নয়।”
তারেক রহমান বর্তমান সরকারের আর্থিক সংস্কারের পদক্ষেপগুলোকে অপ্রতুল হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, যা সরাসরি সাধারণ জনগণের ওপর প্রভাব ফেলে। বাজার স্থিতিশীল করা, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং দুর্নীতি নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়া অর্থনীতির উন্নতি সম্ভব নয়।”
দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “দেশের বর্তমান সংকট নিরসনের জন্য নির্বাচনই একমাত্র সমাধান। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।”
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, “নির্বাচনব্যবস্থা, প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলার সংস্কার এখন সময়ের দাবি। তবে, এই প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।”
তিনি সতর্ক করেন, “যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। জনগণকে জানাতে হবে, সরকার কতদিনের মধ্যে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে প্রস্তুত। এটি না হলে অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের আস্থা হারাবে।”
সম্মেলনের গুরুত্ব এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
জাতীয়তাবাদী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের এই সম্মেলনে সংগঠনের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। ফখরুল আলমকে সভাপতি এবং রুহুল আমিন আকন্দকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। সম্মেলনে বক্তব্য দেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
সম্মেলনে বক্তারা অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করেন এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণে তাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান।
বিশ্লেষকদের মতামত
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তারেক রহমানের বক্তব্য একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা বহন করে। তিনি যেমন সরকারের অদক্ষতা এবং ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা করেছেন, তেমনই একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য জনগণের আস্থার গুরুত্বও তুলে ধরেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী হাসান বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। তাদের দায়িত্ব হলো জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। যদি তারা ব্যর্থ হয়, তবে ভবিষ্যতে বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।”
ড. হাসান আরও বলেন, “সরকারকে এখনই তাদের অগ্রাধিকারগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বাড়াতে হবে। গণতন্ত্র এবং অর্থনীতি পুনর্গঠনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।”
বিএনপির নেতাদের বক্তব্য এবং বিশ্লেষকদের অভিমত থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট—অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এখনই সময় তাদের কার্যক্রমের গতি এবং দিক নির্ধারণ করার। জনগণের আস্থা ধরে রাখতে হলে এই সরকারের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা এবং দক্ষতা নিশ্চিত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।