,

হিন্দু সম্প্রদায় কী চাইছে, তারা এখন কেন রাস্তায়

সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ ও অধিকার সুরক্ষায় সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ দাবি

চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে সনাতন সম্প্রদায়ের আয়োজিত একটি বিশাল সমাবেশ থেকে আট দফা দাবি আদায়ের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

শুক্রবার অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে সরকারের কাছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের দাবি জানানো হয়েছে।

এই সমাবেশ থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে লংমার্চের ঘোষণাও করা হয়েছে, যা দেশের রাজনীতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

সমাবেশে উপস্থিত বক্তারা দাবি করেন, এই আন্দোলন সাধুসন্তদের পক্ষ থেকে পরিচালিত এবং এর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকারের সম্পর্ক নেই।

তাদের মতে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য।

সংগঠনহীন সাধুসন্তদের উদ্যোগ, জনগণের ব্যাপক সমর্থন

সমাবেশের আয়োজকরা জানিয়েছেন, এটি কোনো প্রতিষ্ঠিত সংখ্যালঘু সংগঠনের উদ্যোগে নয় বরং সাধুসন্তদের নিজস্ব উদ্যোগে পরিচালিত।

এবারের সমাবেশে সংগঠনের সদস্য ছাড়াও সাধুসন্তদের উপস্থিতি ও সমাবেশের বক্তব্যগুলো গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বলে আয়োজকদের বিশ্বাস।

প্রধান বক্তা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী এই আন্দোলনকে সম্পূর্ণ ধর্মীয় এবং সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে বলে উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেন, “এটি কোনো সরকারের পক্ষ বা বিপক্ষে আন্দোলন নয়; এটি সংবিধান অনুযায়ী সাম্য এবং ধর্মীয় সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সাধুসন্তদের উদ্যোগ।”

নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন: সনাতন জাগরণ মঞ্চের দাবি

সনাতন জাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক কাঞ্চন আচার্য জানিয়েছেন, তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা।

তার মতে, গত ৫৩ বছরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হওয়া নানা সহিংসতার একটিরও বিচার হয়নি।

তিনি বলেন, “আমরা আমাদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ চাই। ন্যায়বিচার ছাড়া দেশের কোনো সম্প্রদায়ই নিরাপদ নয়।”

চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী আরও বলেন, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে উপেক্ষা করা হচ্ছে, যা একটি পুরনো কৌশল।

তাঁর মতে, সংখ্যালঘুদের প্রতি সাম্য ও নিরাপত্তার দাবিতে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

আট দফা দাবির মূল বিষয়গুলো

লালদীঘির সমাবেশ থেকে সনাতন সম্প্রদায় তাদের যে আট দফা দাবি তুলেছে তার মধ্যে রয়েছে:

১. সংখ্যালঘু নির্যাতনের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন।

২. সংখ্যালঘু নির্যাতনের শিকারদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন।

৩. সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন।

৪. সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন।

৫. হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে ফাউন্ডেশনে উন্নীত করা।

৬. দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন।

৭. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপাসনালয় নির্মাণ এবং হোস্টেলে প্রার্থনার জন্য আলাদা কক্ষ।

৮. দুর্গাপূজায় পাঁচ দিনের সরকারি ছুটি।

সমাবেশে বক্তারা জানান, সংখ্যালঘু সুরক্ষায় পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের হামলা ও সহিংসতার ঘটনা আরও বাড়তে পারে।

সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাগুলো ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি

সনাতন সম্প্রদায়ের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী বলেন, গত দশ বছরে নানা সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও একটিতেও দোষীদের বিচার হয়নি।

তিনি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন, ২০২১ সালে দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে কোরআন পাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে মন্দিরে হামলা এবং ভাঙচুরের ঘটনা।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজারের বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে মন্দির ও পূজামণ্ডপে আক্রমণও অন্তর্ভুক্ত।

সরকারের ভূমিকা ও ধর্মীয় উপদেষ্টার বক্তব্য

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের তরফ থেকে এখনো কোনো নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

তবে সরকারের ধর্মীয় উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, “বাংলাদেশে প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, সরকার এই অধিকার রক্ষায় সজাগ রয়েছে এবং তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাজনৈতিক সংকটের আশঙ্কা এবং আন্দোলনের সময়কাল

চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী দাবি করেন, তাদের আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলকে সুবিধা দেওয়ার জন্য নয় বরং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য।

তিনি আরও বলেন, “যখনই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ কথা বলে তখন তাকে রাজনৈতিক ট্যাগ দেওয়া হয় এবং ভারতকে টেনে এনে সাম্প্রদায়িক অপব্যাখ্যা করা হয়।”

তাঁর মতে, সবার সমান অধিকার ও সুরক্ষার জন্য সরকারকে সকল সম্প্রদায়ের প্রতি সাম্যনীতি অনুসরণ করতে হবে।

অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষণ এবং সনাতন সম্প্রদায়ের উদ্বেগ

সমাবেশে বক্তারা উল্লেখ করেন, সরকার মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য পাঁচ শতাধিক মসজিদ নির্মাণ করেছে যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

কিন্তু তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য একই ধরনের উদ্যোগ কোথায়?

চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী বলেন, “আমরা ধর্মীয় অনুভূতির প্রশ্নে শাস্তি পেতে প্রস্তুত থাকি, কিন্তু আমাদের অধিকার রক্ষা করতে সরকারের সাড়া প্রয়োজন।”

তিনি বলেন, ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘুদের চাকরিচ্যুত করা, পদাবনতি দেওয়া এবং জীবিকা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে যা গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার দাবি

আওয়ামী লীগ আমলে সনাতন সম্প্রদায় বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ করলেও, এত ব্যাপকভাবে আন্দোলনের পথে নামেনি বলে অনেকে মত দিয়েছেন।

বক্তারা উল্লেখ করেন, ২০২১ সালে দুর্গাপূজার সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় ১৫৪টি দেশে প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী বলেন, “আমাদের উপর যে অত্যাচার চালানো হচ্ছে তার বিচার চাই। সরকারের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে কিন্তু এখনও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের লক্ষণ পাওয়া যায়নি।”

প্রতিবাদে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের তাগিদ

চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী জানান, বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর হামলা চালানো হচ্ছে, তাদের চাকরি থেকে সরানো হচ্ছে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে বাধা দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, “আমরা রাস্তায় নেমেছি কারণ পরিস্থিতির পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।”

তাঁর মতে, সরকার যদি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা না করে তাহলে দেশের সাম্প্রদায়িক স্থিতিশীলতা রক্ষায় বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে।

সমাবেশে আরও বক্তব্য ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি

সমাবেশে উপস্থিত বক্তারা বলেন, “যদি আমাদের উপেক্ষা করা হয় তাহলে এই দেশ আফগানিস্তান বা সিরিয়ার মতো হয়ে উঠবে।”

তাঁরা উল্লেখ করেন, চাকরিচ্যুতির ঘটনা থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাধা দেওয়া হচ্ছে যা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।

তাঁদের মতে, তাদের কথা উপেক্ষা করা হলে দেশের সাম্প্রদায়িক স্থিতিশীলতায় বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের সনাতন সম্প্রদায়ের অধিকার ও সুরক্ষা বিষয়ে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

দেশের সাম্প্রদায়িক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সকল সম্প্রদায়ের অধিকার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি বলে মনে করেন আন্দোলনকারীরা।

আরও পড়তে পারেন