গাজায় প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা লড়াইয়ের মধ্যে ইসরায়েল এখন আরও এক ফ্রন্টের আশঙ্কা করছে, কারণ তারা হিজবুল্লাহর সাথে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। লেবাননে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক অভিযানগুলো বিশেষ করে হিজবুল্লাহর যোগাযোগ ডিভাইস লক্ষ্য করে পরিচালিত গোপন অভিযান এবং বিমান হামলা— পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে, যেখানে শত শত মানুষ নিহত হয়েছে।
গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ইতোমধ্যে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। সৈন্যরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম পাচ্ছে না, জনবল সংকট দেখা দিয়েছে, অর্থনীতি ক্রমাগত নিম্নমুখী, এবং জনগণের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও বন্দী বিনিময়ের জন্য চাপ বাড়ছে। এতদসত্ত্বেও, ইসরায়েলের সামনে আরেকটি বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে— তারা কি একটি দ্বিতীয় ফ্রন্ট সামলাতে পারবে?
উত্তরের উত্তেজনা বৃদ্ধি
হিজবুল্লাহর সাথে ইসরায়েলের সরাসরি সংঘাতের সম্ভাবনা এখনও অনিশ্চিত, কিন্তু উত্তেজনা বাড়ছে। অক্টোবরের ৮ তারিখ, হামাসের একটি ভয়াবহ আক্রমণের পরপরই, লেবাননের সীমান্ত জুড়ে দুই পক্ষের মধ্যে নিয়মিত গোলাবিনিময় শুরু হয়। হিজবুল্লাহ প্রথমে গাজার যুদ্ধের প্রতিবাদে ইসরায়েলে হামলা চালায় এবং গাজায় যুদ্ধবিরতি দাবি করে।
গত সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও উত্তেজনাকর হয়ে ওঠে, যখন ইসরায়েল লেবাননে হাজার হাজার মানুষকে আহত করে এবং হিজবুল্লাহর ব্যবহৃত পেজার ও ওয়াকি-টকির মতো ডিভাইস ধ্বংস করে। এর ফলে সীমান্তের উভয় পাশে গোলাগুলির মাত্রা বাড়তে থাকে।
যদি ইসরায়েল হিজবুল্লাহর সাথে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তারা হামাসের তুলনায় অনেক শক্তিশালী শত্রুর সম্মুখীন হবে। হিজবুল্লাহ কেবল একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী নয়, এটি “রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র” হিসেবে পরিচিত, যার সামরিক ও কৌশলগত গভীরতা রয়েছে।
শক্তিশালী শত্রু: হিজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতা
হিজবুল্লাহ, যা ইরানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আঞ্চলিক মিত্র, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের সামরিক সক্ষমতা আরও বাড়িয়েছে। ইয়োয়েল গুজানস্কি, যিনি ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে কাজ করেছেন এবং বর্তমানে তেল আবিবের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের একজন গবেষক, সিএনএনকে বলেন, “হিজবুল্লাহ কেবল হামাস নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের মতো— তাদের সামরিক ক্ষমতা ও সংস্থান অনেক বেশি উন্নত।”
হিজবুল্লাহর প্রায় ১২০,০০০ থেকে ২০০,০০০ রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হয়, যার মধ্যে কয়েকটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। এছাড়া এর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ দাবি করেছেন যে তাদের ১০০,০০০ এরও বেশি যোদ্ধা ও রিজার্ভ সৈন্য রয়েছে। হিজবুল্লাহর প্রধান শক্তি তাদের দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, যার সাহায্যে তারা ইসরায়েলের গভীরে আঘাত হানতে সক্ষম।
গত সপ্তাহে, হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের রামাত ডেভিড বিমান ঘাঁটিতে এফাদি ১ এবং এফাদি ২ নামক নতুন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আক্রমণ চালায়, যা দূরপাল্লার অস্ত্র হিসেবে এই প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে। এই ঘাঁটি লেবাননের সীমান্ত থেকে প্রায় ৩০ মাইল দূরে অবস্থিত। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এই ঘাঁটিতে আক্রমণের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, তবে জরুরি পরিষেবা জানিয়েছে যে তিনজন আহত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হিজবুল্লাহর সাম্প্রতিক আক্রমণ তাদের মুখ রক্ষার একটি কৌশল হতে পারে, বিশেষ করে ইসরায়েল সম্প্রতি তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় হামলা চালানোর পরে। তবে এতে হিজবুল্লাহ তাদের প্রধান নেতাদের উপর আক্রমণের প্রতিশোধও নিতে চায়।
সামরিক শক্তির চ্যালেঞ্জ
ইসরায়েল একটি ছোট রাষ্ট্র এবং তাদের সামরিক জনবল সীমিত। একাধিক ফ্রন্টে লড়াই করা তাদের জন্য কঠিন হতে পারে। গাজা থেকে তাদের কিছু মূল সামরিক বাহিনী উত্তরের দিকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োয়াভ গালান্ট বলেছেন, “যুদ্ধের প্রধান কেন্দ্র এখন উত্তরের দিকে স্থানান্তরিত হচ্ছে।” এই কারণে সামরিক সরঞ্জাম ও সৈন্যও উত্তরের সীমান্তে পাঠানো হচ্ছে।
এছাড়া, এই দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের কারণে সৈন্যদের শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি বেড়ে চলেছে। অক্টোবরের হামলার পর থেকে প্রায় ৭১৫ জন সৈন্য নিহত হয়েছে, যার মধ্যে অনেকেই উত্তরে লড়াই করেছে। এই দীর্ঘ লড়াইটি ইসরায়েলের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতগুলোর মধ্যে একটি, এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন হিজবুল্লাহ এবং ইরানের মূল লক্ষ্য ইসরায়েলকে ক্রমশ দুর্বল করা এবং তাদের সেনাবাহিনীকে অতিরিক্ত চাপের মধ্যে ফেলা।
অর্থনৈতিক মন্দা
যুদ্ধের প্রভাব ইসরায়েলের অর্থনীতিতে মারাত্মকভাবে পড়েছে। শুরু থেকেই হাজার হাজার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কারণ রিজার্ভ সৈন্যরা তাদের স্বাভাবিক জীবন ত্যাগ করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। ইসরায়েলের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে। এর পাশাপাশি সামরিক ব্যয় আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে। ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে এই যুদ্ধ ইসরায়েলকে প্রায় ২৫৩ বিলিয়ন ইসরায়েলি শেকেল ($৬৭ বিলিয়ন) খরচ করতে হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের সামরিক ব্যয় ইতিমধ্যেই বার্ষিক ৪.৫% থেকে ৬.৫% জিডিপি-তে দাঁড়িয়েছে। তবে যুদ্ধের কারণেই এই ব্যয় আরও বেড়ে চলেছে, এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলবে।
বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া ও বৈধতার সংকট
গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের প্রাথমিক আন্তর্জাতিক সমর্থন দ্রুতই সমালোচনার মুখে পড়েছে, এবং বর্তমানে দেশটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের সম্মুখীন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আদালতগুলোতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ দায়ের হয়েছে, যদিও দেশটি এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
গাজার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রথমদিকে ইসরায়েলি জনসাধারণের মধ্যে দৃঢ় সমর্থন থাকলেও, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় দেশটির জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। সর্বশেষ জরিপ অনুসারে, অনেক ইসরায়েলি উত্তরের ফ্রন্টে আরেকটি যুদ্ধে জড়ানোর পরিবর্তে কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। বিশেষ করে উত্তরের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারীরা বিশ্বাস করেন, এই অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইসরায়েলের একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের প্রয়োজন হতে পারে।
তবে এমন একটি যুদ্ধ আন্তর্জাতিক সমালোচনা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে, এবং যুদ্ধের বৈধতা নিয়ে আরও প্রশ্ন তুলতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হিজবুল্লাহর সাথে যুদ্ধে জড়ালে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে ইসরায়েলের জন্য কূটনৈতিক সমর্থন হারানোর সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।
তথ্যসূত্র: সিএনএন